পিয়া রায়
বেলজিয়ামে দুর্গাপুজো প্রবাসী বাঙালি এবং ভারতীয় সম্প্রদায়ের জন্য এক অনন্য আবেগের উৎসব। ইউরোপের এই দেশটি মূলত খ্রিস্টান প্রধান হলেও বহুসাংস্কৃতিক পরিবেশে বাঙালিরা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে এই পুজোকে কেন্দ্র করে এক বৃহৎ মিলনমেলার আয়োজন করেন। বিশেষত ব্রাসেলস, অ্যান্টওয়ার্প, গেন্ট এবং লুভেনের মতো বড় শহরগুলোতে প্রতিবছর দুর্গোৎসব পালিত হয়। এই আয়োজনগুলোর পেছনে থাকে স্থানীয় বাঙালি সংগঠনগুলির শ্রম এবং উৎসাহ। পূজা সাধারণত ভাড়া করা হল, কমিউনিটি সেন্টার বা অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অস্থায়ী মণ্ডপ তৈরি করে প্রতিমা স্থাপন করা হয়।
প্রতিমা সচরাচর কলকাতা থেকে আনা হয় না, কারণ পরিবহন খরচ এবং কাস্টমসের জটিলতা এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। তাই অনেক সময় ফাইবারগ্লাস বা প্লাস্টারের তৈরি প্রতিমা স্থানীয়ভাবে সংরক্ষিত থাকে, যা বছর বছর পূজায় ব্যবহৃত হয়। তবে আচার-বিধি পালনে কোনও ছাড় দেওয়া হয় না। সকালবেলা পঞ্জিকা অনুযায়ী অষ্টমী, নবমী, দশমীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়, পূজার মন্ত্রোচ্চারণ, অঞ্জলি, আরতি, ধুনুচি নাচ সবই নিয়ম মেনে হয়। ভোগের আয়োজনও প্রবাস জীবনে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি, পায়েসের মতো খাবার রান্না করে সমবেতভাবে সকলকে পরিবেশন করা হয়, যা বিদেশের মাটিতে বাঙালির হৃদয়ে মাতৃভূমির স্বাদ এনে দেয়।
বেলজিয়ামের দুর্গাপুজো মূলত বহুসাংস্কৃতিক সংযোগেরও ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। স্থানীয় বেলজিয়ান এবং অন্যান্য ইউরোপীয় নাগরিকরা এই উৎসবে যোগ দেন, ভারতীয় সংস্কৃতি ও বাঙালি ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হন। অনেকে সঙ্গীত, নৃত্য ও নাটকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। প্রবাসী শিশু-কিশোরদের জন্য এই উৎসব বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে তারা তাদের শিকড়ের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, আধুনিক গান, লোকনৃত্য এবং নাট্যাভিনয়ের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
প্রবাস জীবনের ব্যস্ততা ও একাকিত্বের মধ্যে দুর্গাপুজো বাঙালিদের জন্য মানসিক আশ্রয় তৈরি করে। পাঁচ দিনের এই উৎসব সবার মধ্যে একাত্মতার বোধ জাগিয়ে তোলে। নবমীর রাতে ধুনুচি নাচ কিংবা দশমীর সিঁদুরখেলায় চোখেমুখে ফুটে ওঠে আপনজনের উচ্ছ্বাস, যদিও তারা হাজার মাইল দূরে রয়েছেন জন্মভূমি থেকে। দেবী দুর্গার পূজা এখানে কেবল ধর্মীয় আচার নয়, বরং সামাজিক বন্ধন, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং আনন্দ-উৎসবের এক বিরল সমন্বয়।
ফলে বলা যায়, বেলজিয়ামে দুর্গাপুজো একদিকে যেমন দেবী দুর্গার প্রতি ভক্তির প্রতীক, অন্যদিকে এটি প্রবাসী বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের অংশ। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর আনন্দের সমাহারে এই পুজো বেলজিয়ামে বসবাসরত বাঙালিদের কাছে হয়ে ওঠে বছরের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত উৎসব।
ছবি: সংগৃহীত
