নরেন্দ্রনাথ কুলে
সম্প্রতি দুর্গাপুর কেন্দ্রীয় কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক অনুষ্ঠানে পুরীর শঙ্করাচার্য উপস্থিত ছিলেন । কারিগরী শিক্ষার পড়ুয়াদের সাথে প্রশ্নোত্তর পর্বে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন । এমনকি কয়েকজন শিক্ষার্থী নাকি পৃথক এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে । কারিগরী শিক্ষার্থীদের মার্গ দর্শনে পুরীর শঙ্করাচার্যের যদি ডাক পড়ে তাহলে প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা কি ? প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে মার্গ দর্শনের পথ কি মন্দির ভিত্তিক চর্চার পথ ? যদিও দুর্গাপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বলেছেন যে 'ভারতীয় জ্ঞান পরম্পরা' বিষয়ের চর্চা সাপেক্ষে পুরীর শঙ্করাচার্য আমন্ত্রিত । ভারতীয় জ্ঞান পরম্পরার চর্চা কি মঠ, মন্দির, বেদ, বেদান্তের চর্চা ? ভারতীয় জ্ঞান কেবল এ পরিসরেই সীমাবদ্ধ ? এই সীমাবদ্ধতায় বিজ্ঞানের যুক্তি পরীক্ষার খাতায় এবং কারিগরি বিদ্যা ব্যতীত অধিকাংশ মানুষ আর প্রয়োগ করে না । বিজ্ঞানের ছাত্রের যদি বৈজ্ঞানিক যুক্তি নিয়ে না চলতে পারে, তাহলে সাধারণ মানুষ চলবে তা আশা করা যায় না । চন্দ্রযান-৩ র সফল অভিযানে বিজ্ঞানীর মন্দিরে পূজা সে কথাই বলে দিয়েছে । এ বিষয়ে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কথা বিজ্ঞানের ছাত্ররা আজও প্রাসঙ্গিক করে তুলছেন । তিনি বলেছেন, ছাত্ররা চন্দ্রগ্রহণ কেন হয় তা বুঝিল, পরীক্ষায় লিখিল, পাশ করিল কিন্তু চন্দ্রগ্রহণ হইলে খোল-করতাল লইয়া শোভাযাত্রা করিতে ভুলিল না । আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা এই পথকে আরো সমৃদ্ধ করতে চলেছে ।
নেতাজি বলেছিলেন, "ধর্মের নামে, দেশের নামে বা রাজনীতির নামে কোন প্রকার গোঁড়ামি যেন আমাদের শিক্ষামন্দিরে প্রবেশ করিতে না পারে, সেদিকে আমাদের দৃষ্টি রাখা উচিত ।" কিন্তু নেতাজির এই ভাবনা থেকে আমাদের দৃষ্টি-যে একেবারে নেই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । আবার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন- "বিশ্ববিদ্যালয় কোন কোন বিষয় পড়াবেন এবং কোন পদ্ধতিতে পড়াবে ও গবেষণা করবে, সে ব্যাপারে অবশ্যই বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে । আমাদের একে একইভাবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে রাজনৈতিক বাধা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পুরোহিততন্ত্রের বাধা---সমস্ত দিক থেকে মুক্ত রাখতে হবে ..।" কিন্তু আজকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এই সমস্ত দিক থেকে মুক্ত করার প্রয়াস ক্রমশঃ ক্ষীণ হয়ে পড়েছে । তাছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধর্মীয় কুসংস্কারগ্রস্থ করে তুলতে সরকার ও তাঁর প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে । সরকার ও তাঁর প্রশাসনের এমন পদক্ষেপ সম্পর্কে বিশিষ্ট দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের কথা আজ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য । তিনি বলেছিলেন, "এটা কোনো মতে সহ্য করা যায় না যে, একটি সরকার তার সরকারি ক্ষমতাবলে বা অন্য কোনভাবে জনসাধারণের শিক্ষার উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রাখবে । এই ধরনের ক্ষমতা থাকলে বা বাস্তবে তাকে প্রয়োগ করলে তা স্বৈরতান্ত্রিক হতে বাধ্য । যে সরকার জনসাধারণের মতামত ও আবেগকে ছোটবেলা থেকে পরবর্তী জীবন পর্যন্ত নিজেদের মত করে গড়ে তুলতে পারে সেই সরকার তাদেরকে দিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে ।" তাহলে আজকে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবেশে জন মিলের কথার প্রাসঙ্গিকতা এখনো শেষ হয়ে যায় নি ।

