বিয়ার ব্রাউন
অনুবাদ: পিয়া রায়
পাহাড়—প্রকৃতির সেই মহিমান্বিত সৃষ্টিগুলোর অন্যতম, যা যুগে যুগে মানুষকে মুগ্ধ করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে, আর এক অদ্ভুত প্রশান্তির আবেশে ডুবিয়ে দিয়েছে। ‘মাউন্টেন ডে’ এই প্রাকৃতিক বিস্ময়কে স্মরণ করার, এর গুরুত্ব উপলব্ধি করার এবং পাহাড় সংরক্ষণের অঙ্গীকার করার একটি বিশেষ দিন। পৃথিবীর ভূপ্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ পাহাড় কেবল একটি ভৌগোলিক গঠন নয়, বরং মানব সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
পাহাড়ের জন্ম প্রায়শই কোটি কোটি বছরের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফল। মহাদেশীয় প্লেটের সংঘর্ষ, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, কিংবা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয় ও ভাঁজ—এসব মিলিয়ে পাহাড় গড়ে ওঠে। পৃথিবীর বৃহত্তম পর্বতমালা হিমালয়, যার বুকে রয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্ট, প্রায় ৬ কোটি বছর আগে ভারতীয় ও ইউরেশীয় টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষে জন্ম নিয়েছিল। তেমনি অ্যান্ডিজ, আল্পস, রকি—প্রতিটি পাহাড়ের জন্মকথা যেন প্রকৃতির নিজস্ব এক গোপন মহাকাব্য।
পাহাড় শুধু দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যের উৎস নয়, এটি জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য ভান্ডার। উচ্চতার ভিন্নতায় জলবায়ু ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্য পাহাড়কে করে তোলে অসংখ্য বিরল প্রাণী ও উদ্ভিদের আশ্রয়স্থল। বিশ্বজুড়ে প্রায় ১২% মানুষ পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করে, আর আরও কয়েকশো কোটি মানুষ পাহাড়ের পানি, বনজ সম্পদ, ওষুধি উদ্ভিদ এবং কৃষিজ পণ্যের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বের বহু বৃহৎ নদীর উৎস পাহাড়ে—যেমন গঙ্গা, যমুনা, সিন্ধু, মেকং, ইয়াংজি—যা কোটি কোটি মানুষের জীবনরেখা।
তবে আধুনিক যুগে পাহাড়ি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিপদের মুখে। জলবায়ু পরিবর্তন, অবৈধ বন উজাড়, খনিজ আহরণ, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন এবং গ্লেসিয়ারের দ্রুত গলন পাহাড়ের ইকোসিস্টেমকে সংকটে ফেলেছে। পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষদের জীবনও কঠিনতর হয়ে উঠছে—প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে, খাদ্য ও পানির প্রাপ্যতা কমছে, এবং জীবিকা হারানোর আশঙ্কা বেড়েছে।
পাহাড় মানুষের সংস্কৃতি ও চেতনারও এক বিশাল ভান্ডার। প্রাচীনকাল থেকেই পাহাড়কে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে। হিমালয়কে হিন্দু ধর্মে দেবভূমি বলা হয়, যেখানে দেব-দেবীর আবাস কল্পনা করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মে তিব্বতের কৈলাস পর্বতকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র বলা হয়। বিশ্বের নানা প্রান্তে পাহাড়কে ঘিরে অসংখ্য লোককথা, মিথ ও উপকথা গড়ে উঠেছে, যা মানুষের বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও পাহাড়ের গুরুত্ব অপরিসীম। পাহাড়ি অঞ্চলে কৃষি, পশুপালন, হস্তশিল্প, খনিজ সম্পদ আহরণ এবং পর্যটন স্থানীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। বিশেষ করে অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন—ট্রেকিং, মাউন্টেন ক্লাইম্বিং, স্কিইং—বছরে কোটি কোটি ডলারের শিল্পে পরিণত হয়েছে। তবে এই অর্থনৈতিক কার্যকলাপ পরিবেশের ক্ষতি না করে যেন টেকসই হয়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি।
মাউন্টেন ডে কেবল পাহাড়ের সৌন্দর্য উদযাপনের দিন নয়, বরং পাহাড় সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করারও সময়। পাহাড় রক্ষা মানে শুধু একটি প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম, সংস্কৃতি ও অসংখ্য জীবনের অস্তিত্ব রক্ষা। আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে পাহাড় সংরক্ষণে ভূমিকা রাখা যেতে পারে—যেমন দায়িত্বশীল ভ্রমণ, পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার, এবং পাহাড়ি অঞ্চলে প্লাস্টিক বা দূষণ কমানো।
প্রকৃতি আমাদের যা দিয়েছে, তা রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। পাহাড় আমাদেরকে অক্সিজেন, পানি, খাদ্য, ঔষধ, এবং মানসিক প্রশান্তি দিয়েছে। সময় এসেছে আমরা পাহাড়কে সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে দিই। মাউন্টেন ডে যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—পাহাড় কেবল ভ্রমণের গন্তব্য নয়, বরং জীবন ও পৃথিবীর এক অপরিহার্য ভিত্তি, যার সুরক্ষা আমাদের সবার দায়িত্ব।


