"ভোর রাত্রে বাড়ির সামনে রাস্তায় হৈ - চৈ চেঁচামেচি শুনে ও' র ঘুম ভেঙে যায়। উনি উঠে নিচে নেমে যান। গিয়ে দেখেন ওদের বাড়ির ঠিক সামনেই, দুটো অল্প বয়সী ছেলেকে পাড়া শুদ্ধ লোক দারুন ঠেঙাচ্ছে, তাদের চোখ মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি গেট খুলে বেরিয়ে চোর দুটিকে ক্রুদ্ধ জনতার হাত থেকে উদ্ধার করে বাড়ির মধ্যে টেনে এনে গেট বন্ধ করে দেন। জনতা এতে আরো রেগে যায়, আপত্তি করতে থাকে। তাদের হাতে ওদের ফিরিয়ে দিতে হবে। শরৎচন্দ্র তাদের বলেন - বামাল যখন ধরা পড়েছে, তখন ওদের পুলিশে দিতে পারো তোমরা, কিন্তু খুন করে ফেলতে পার না।
তখন বাড়ির লোকেরা শরৎদার বাড়ির দোতলায় উঠে এসে পুলিস খবর দেয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে বামাল সমেত চোর দুটিকে পাওয়া যাবে পুলিস স্টেশনে বলে দেওয়া হয় ।
চোর দুটির চোখ মুখ তখন ভীমরুল কামড়ানোর মতন ফুলে উঠেছে । উনি নিজে তাদের আইডিন তুলোটুলো এনে শুশ্রুষা করেছেন। খুবই কাতর হয়ে পড়েছেন তাদের জন্য। দু ' গেলাস গরম চা বানিয়ে দেবার হুকুম করেছেন। এদিকে চোরেরা কিন্তু ও'র দুই পা জড়িয়ে কান্না শুরু করেছে - 'আমাদের পুলিশে দেবেন না বাবু, যত খুশি আপনারাই মারুন। আর কখনো এমন কাজ করবো না।' কিন্তু, তখন তো আর উপায় ছিল না। একটু পরেই পুলিশের গাড়ি এসে ছেলে দুটোকে ধরে নিয়ে চলে গেলো। পাড়ারই পন্ডিতিয়া বস্তির ছেলে ওরা।
সেই থেকে উনি বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বলছেন - আমিই ছেলে দুটোর জীবনে সর্বনাশ করে দিলাম।
........ কুড়ি - একুশ বছরের ছেলে দুটো একেবারে দাগী চোর হয়ে গেলো। ওদের বাঁচবার পথ আমিই বন্ধ করে দিলাম নরেন। পুলিশে যে আরও ওদের মারবে না তারই গ্যারান্টি কি আছে ? - শুধু নিজের নার্ভকে, নিজের বিবেককে আরাম দেবার জন্য আমি ওদের মারধোর বন্ধ করে ফোন করে জেলে পাঠালাম। এটা মোটেই করুণা নয়, উদারতা তো নয়ই, এ কেবল স্বার্থকেন্দ্রিকতা । আমি ওই বীভৎস মার চোখে দেখতে পারছিলুম না, সহ্য করতে পারছিলুম না। আমার মুহূর্তের অস্বস্তিটাই বড় কথা হলো। তাই মের না, বরং পুলিস দাও - বলে বসলুম।
.... ওরা যে চোর হয়েছে, এটা কাদের দোষ? এই আমরা, আমাদেরই দোষে। আমরা যারা ওদের ধরে ঠ্যাঙাচ্ছিলুম, ওদের পুলিশে দিলাম। এই আমরাই ওদের চোর বানিয়েছি। এই উচ্চবিত্ত সমাজের অন্যায়ে, অত্যাচারে, স্বার্থপরতা আর অবিশ্বাসে বস্তির ছেলেগুলো চোর হয়। ওরা তো চোর জোচ্চোর হতো না। যদি কপাল গুণে এই দোতলা বাড়িতে জন্মাত ; কোথায় ওদের নিঃস্ব জীবনটাকে গড়ে তোলার জন্য হাত বাড়িয়ে দেব, সর্বদা ওদের অবিশ্বাসের নজরে আর ঘেন্নার নজরে ঘিরে রেখেছি। কি করে ওরা সৎ হবে, সাধু হবে ? কি আছে আশেপাশে ওদের সম্বল ? অবিশ্বাস, অশ্রদ্ধা ছাড়া জীবনে কিছুই পায় না ওরা।
এই আমাকেই দেখ না। কি করলুম আমি ওদের জন্যে ? পুলিশে ধরিয়ে দিলুম। কোথায় ওদের ভ্রষ্ট জীবনটাকে নতুন করে গড়বার সুযোগ করে দেব, তা না করে থানায় পাঠিয়ে নিশ্চিত হলুম। তার ফল এই, ওরা দাগী হয়ে গেল, ক্রমশ আরো বদ কাজ করতে করতে নিচে নামতে থাকবে। কারণ, ওরা কাজ করার আর সুযোগ পাবে না। আমি তো ওদের পানিত্রাসে নিয়ে যেতে পারতুম, চাষবাসের কাজ শেখাতে পারতুম। ওদের চুরি করার মূল কারণটা দুর করার চেষ্টা করা উচিত ছিল নাকি? তা নয়, ওদের জন্মের শোধ, দাগী চোর করে ছেড়ে দিলুম।"
তথ্যসূত্রঃ রাধারাণী দেবী (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ ), শরৎচন্দ্র : মানুষ ও শিল্প, কলকাতা, পৃষ্ঠা: ১৪-১৭ ।
তথ্যসংগ্রহ ও সম্পাদনা: রাজীব সিকদার

