রাজীব সিকদার
প্রকৃতিতে সৃষ্ট ঘন অন্ধকারে প্রবেশ করলে একটা গা ছমছম ভয়ের ভাব তৈরি হয়। যা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এই অন্ধকারে যদি নানান ধরনের ছোটো বড় আওয়াজ কানে আসে তাহলে সাধারণ ভাবে ভয় মাত্রা অতিক্রম করে স্নায়ু দুর্বলতা প্রবল আকার নিতে পারে । একই ভাবে মানুষ যখন লাইব্রেরি বা উপাসনালয়ের মতো কৃত্রিম কোনো পরিবেশ তৈরি করে তখন অবিচ্ছিন্ন নীরবতা চরম মাত্রায় থাকে। এই নীরবতা অনেকটা প্রকৃতি সৃষ্ট সেই ঘন অন্ধকারের মতো। সেখানে বাইরে থেকে কেউ প্রবেশ করলে কোনো ধরনের আওয়াজ বা উপদ্রব তৈরিতে বিবেক বাধা দেয়। শিশু কিম্বা কোনো অসুস্থ মানুষ যখন ঘুমায় তখনও কোনো বাহ্যিক শব্দ সৃষ্টিতে একটা ভয় কাজ করে। গভীর জঙ্গলেও প্রাণীরা তাদের মিলিত বা আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া পরিবেশের নীরবতা ভাঙ্গে না। কোনো অস্বাভাবিক আওয়াজ কিম্বা আলো বা কখনও ঘন অন্ধকারের পরিবেশকে বন্য প্রাণীরা ভয় পায়। এসব ভয়ই আসলে উদ্ভূত হয় প্রবৃত্তি এবং বিবেক থেকে। প্রকৃতি সৃষ্ট এই ভয়ের পরিবেশ মানুষকে সংযত ও আত্মরক্ষা প্রবন করে তোলে। কিন্তু, কোনোভাবেই প্রতিহিংসা বা প্রত্যাঘাত করতে উৎসাহিত করে না। তাই, নীরবতার এই পরিবেশ দুনিয়াকে আক্রমণের পরিবর্তে আত্মরক্ষা করতে শেখায়।
আধুনিক মানুষ সৃষ্ট ধনতন্ত্রের যন্ত্র সভ্যতা আত্মরক্ষার পরিবর্তে আক্রমনকেই গুরুত্ব দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই পৃথিবীর নীরবতা ভাঙিয়ে গগনভেদী আওয়াজ তৈরিতে ধনতন্ত্র এমন ভাবে উৎসাহিত করেছে যে তার কবলে পড়ে একদিকে যেমন সহস্র প্রজাতি আজ বিলুপ্ত, কেউ বা অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে কোনো ভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। এর প্রভাব মানুষকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে নীরবতা রক্ষায় প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতা মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। মানুষের প্রয়োজনীয় উৎপাদন ক্ষেত্রের বাইরেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় শব্দ সৃষ্টির অভ্যাস মাত্রা অতিক্রম করতে করতে বিকৃত পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
ধনতন্ত্রের সৃষ্ট বর্বর, স্বৈরাচারী, যুদ্ধবাজ সম্প্রদায় কোনোভাবেই নীরবতা চাইনা। নীরবতাকে ভয় পায় বলেই নীরবতা সৃষ্টির উৎস গুলোকে এরা ধ্বংস করতে উন্মুখ। আবার শব্দ সৃষ্টিকে অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। বৈষম্য ও লোভের মাত্রা সীমা অতিক্রম করে অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। যা নীরবতার ভাঙবার মননকেই উৎসাহিত করছে। একসাথে থাকতে গিয়ে, কর্মক্ষেত্র বা পরিষেবা প্রতিষ্ঠানে মানুষে মানুষে ভাব বিনিময়ের সময়েও অস্বাভাবিক, বিকৃত শব্দ, কথা বা আওয়াজ পরিবেশনকে মানুষ হাতিয়ার করে ফেলছে। যার ফলে সে হয়ে পড়েছে কোন্দল বা কলহ প্রিয়। এই কোন্দল বা কলহের শুরু বা শেষ কোথায় বর্তমান প্রজন্ম ধরতে তো পারছেই না। বরং শেষ পর্যন্ত প্রতিহিংসা সৃষ্টি, ব্যক্তিগত আঘাত, হত্যা, যুদ্ধকে সমর্থন করে ফেলছে। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর আত্মহত্যা করছে। গৃহের অভ্যন্তর থেকে রাষ্ট্রের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত একই মনস্তত্ত্ব ছেয়ে ফেলেছে । ধনতন্ত্র সৃষ্ট এই মনস্তত্ত্ব গ্রাস করছে পুরো সমাজকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই বিকৃত মানসিক কাঠামো স্থানান্তরিত হচ্ছে বা বর্তাচ্ছে। বাড়ছে পাগলামি, নিজের প্রতি নিজের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দিন দিন কমছে। বিপরীতে ভয়ংকর মাত্রায় বাড়ছে পরনির্ভরশীলতা, লোভ, খবরদারী, ক্ষমতা বৃদ্ধি বা জনপ্রিয় হওয়ার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা।
সমাজ এখনো যদি সম্মিলিত শব্দ বা নীরবতার মাত্র বুঝতে বা ধরতে না পারে তাহলে অজান্তেই আগামী দিনে রক্ত - মাংস - প্রযুক্তি মিশ্রিত অনুভূতি বিহীন বিশৃঙ্খল মানুষের জন্ম হবে। এই মানুষগুলো হবে প্রকৃতি সৃষ্ট স্বাভাবিক মানুষ থেকে অনেক অনেক দূরে। যার ভয়াল প্রভাব বর্তাবে মানুষ ও বাস্তুতন্ত্র উভয়েরই উপর।

