Select language to read news in your own language

শ্রমের ভারে হারিয়ে যায় শৈশবের রঙ


বিয়ার ব্রাউন

 

শিশুরা জন্মায় হাসার জন্য, খেলার জন্য, শেখার জন্য। কিন্তু পৃথিবীর অনেক প্রান্তে এই শিশুরাই রোজ সকাল শুরু করে ভারি হাতুড়ি হাতে, কিংবা ইটভাটার গরম ছাইয়ের পাশে। বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধী দিবস—World Day Against Child Labor—পালিত হয় প্রতিবছর ১২ জুন, উদ্দেশ্য একটাই—এই ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধিকে প্রতিরোধ করা। ইউনিসেফ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)-র মতে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৬ কোটি শিশু এখনও নানা রকম শ্রমে নিযুক্ত, যাদের এক বড় অংশের বয়স ৫ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। এই সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, এ এক করুণ বাস্তব, যেখানে শৈশব বিক্রি হয় ক্ষুধার কাছে, দরিদ্রতার কাছে, অবহেলার কাছে।

বিশ্ব শিশু শ্রম বিরোধী দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা। শিশুশ্রম শুধুমাত্র একটি অপরাধ নয়, এটি একটি শিশুর ভবিষ্যৎ, মনোবিকাশ ও মানবাধিকারকে নিষ্ঠুরভাবে লঙ্ঘন করে। একটি শিশু যখন বইয়ের ব্যাগের বদলে ইট বহনের ঝাঁপি কাঁধে তুলে নেয়, তখন সমাজ হিসেবে আমরা ব্যর্থ হই। এই ব্যর্থতা শুধুই অর্থনৈতিক নয়, এটি আমাদের মূল্যবোধেরও পতন।

শিশুশ্রমের পিছনে রয়েছে বহুমুখী কারণ। দরিদ্রতা তার মধ্যে সবচেয়ে বড়। অনেক সময় পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকলে শিশুরাই জীবিকা নির্বাহের দায়িত্ব নেয়। আবার অনেকে পরিবার থেকেও ঠেলে দেওয়া হয় রাস্তায়, ভিক্ষা করতে, বা ছোটখাটো হোটেলে, গ্যারাজে কিংবা দর্জির দোকানে কাজ করতে। শিশুদের নিরক্ষরতা, সামাজিক সুরক্ষার অভাব, আইন প্রয়োগে দুর্বলতা—সবই শিশুশ্রমকে উৎসাহ দেয়। অথচ, এই শিশুরা যদি শিক্ষা পেত, যদি তাদের হাতে কলম থাকত, তাহলে হয়তো আমাদের সমাজ আরও আলোকিত হতো।

আইনের চোখে শিশুশ্রম একটি অপরাধ। ভারতে ‘The Child and Adolescent Labour (Prohibition and Regulation) Act, 1986’ অনুসারে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনো রকম শ্রমে নিয়োগ করা বেআইনি। তবু বাস্তবে আমরা দেখি, রেলস্টেশনের পাশের দোকান, ধাবা, কারখানা কিংবা নির্মাণ স্থলে শিশুরা ঘামে ভেজা শরীরে কাজ করছে। কোনো কোনো শিশুকে পাচার করে পাঠানো হয় বড় শহরে, যেখানে তারা গৃহকর্মী, ওয়েটার, কিংবা এমনকি অবৈধ কাজেও ব্যবহৃত হয়। এই চক্র ভাঙতে হলে কেবল আইন নয়, প্রয়োজন সচেতনতা, দায়বদ্ধতা এবং কার্যকর পদক্ষেপ।

শিশুশ্রম শুধু শিশুদের শৈশব নষ্ট করে না, তা তাদের সারাজীবনের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যকেও বিপন্ন করে তোলে। অল্প বয়সেই কঠোর পরিশ্রম, বিষাক্ত পরিবেশ, এবং নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তারা হয়ে ওঠে হতাশ, অসুস্থ, এবং আত্মবিশ্বাসহীন। অনেক শিশুই মানসিক বিকারের শিকার হয়, অনেকেই অপরাধের জগতে পা রাখে। তারা বড় হয়ে সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, একটি দেশের ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠে অনিশ্চিত।

তবে এই অন্ধকারের মধ্যেও কিছু আশার আলো দেখা যায়। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সমাজকর্মী, এবং সরকার এখন শিশুশ্রম প্রতিরোধে কাজ করছে। শিশুদের শিক্ষা, পুষ্টি, ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। মিড ডে মিল, সর্বশিক্ষা অভিযান, শিশু সুরক্ষা নীতি—এই সব উদ্যোগ সমাজে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এনেছে। অনেক শিশুই বইয়ের ছায়ায় ফিরে পেয়েছে তার হারিয়ে যাওয়া শৈশব।

কিন্তু পরিবর্তনের জন্য শুধু সরকার বা সংস্থার দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সকলের কর্তব্য। একটি হোটেলে, দোকানে কিংবা রাস্তায় যখনই কোনো শিশুকে কাজ করতে দেখবেন, তখন প্রতিবাদ করুন। আইন অনুযায়ী পুলিশের কাছে অভিযোগ জানান। সেই শিশুকে শিক্ষার আলোয় ফেরাতে উদ্যোগ নিন। সমাজে যদি আমরা সকলে মিলে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে দাঁড়াই, তবে এই অভিশাপকে ধীরে ধীরে নির্মূল করা সম্ভব।

শিশুদের জন্য চাই একটি নিরাপদ পৃথিবী, যেখানে তারা খেলবে, শিখবে, স্বপ্ন দেখবে। শিশু শ্রম থেকে তাদের মুক্ত করা মানে কেবল তাদের রক্ষা করা নয়, বরং আগামী দিনের একটি শক্তিশালী, মানবিক সমাজ গড়ে তোলা। একমাত্র শিক্ষা, সচেতনতা, এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা গড়তে পারি একটি শিশুশ্রমমুক্ত সমাজ।

১২ জুন শুধু একটি দিন নয়, এটি এক কঠিন প্রশ্ন—আমরা কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কেবল শ্রমিক হিসেবে দেখতে চাই, না কি শিক্ষিত, সৃজনশীল নাগরিক হিসেবে? উত্তর আমাদের সবার কাছে। আজকের শিশুই আগামী দিনের সমাজগঠনের মূল স্তম্ভ। তাদের শৈশব যেন কোনো কারখানার ছাদে ঘুমিয়ে না কাটে, বরং বইয়ের পাতায়, রংতুলির ছোঁয়ায়, ও মুক্তির আলোয় আলোকিত হোক—এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

অনুবাদ: পিয়া রায় 

ads banner


ads banner

Bangla eDaily to resume soon