আর বিপ্লব
দেশরক্ষা ও দেশপ্রেম—এই দুটি শব্দ শুধু আবেগ নয়, একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও অগ্রগতির ভিত্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যেমন দেশপ্রেম ছিল জাতীয় চেতনার চালিকাশক্তি, তেমনই আজকের দিনে এই মূল্যবোধ দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব এবং নৈতিক অগ্রগতির অন্যতম স্তম্ভ। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা বিশ্লেষণ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা শুধুই শাসক বা বিরোধী নয়—তারা জনমত গঠন, নীতি নির্ধারণ এবং জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের অংশীদার।
দেশপ্রেম বনাম দলান্ধতা
দেশপ্রেম মানে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্য নয়। এটি একটি বৃহত্তর চেতনার অংশ—যেখানে দেশের স্বার্থ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এবং নাগরিকদের কল্যাণ সর্বাগ্রে বিবেচিত হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় স্বার্থের থেকে দলীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। যেমন, সীমান্ত ইস্যুতে বা সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন হলেও, দলগত অবস্থান বজায় রাখতেই কেউ কেউ বিভাজনমূলক বক্তব্য দিয়ে থাকেন।
জাতীয় নিরাপত্তায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা
ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দল কখনো না কখনো কেন্দ্র বা রাজ্যে ক্ষমতায় থেকেছে। তাদের কাজ শুধু উন্নয়ন বা প্রশাসন চালানো নয়, বরং দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। এখানে কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল, সিপিআই(এম)—সব দলকেই জনগণের চোখে পড়তে হয়।
কংগ্রেস দীর্ঘকাল ধরে দেশ শাসন করেছে। স্বাধীনতার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা শিল্পের আধুনিকীকরণে এদের অবদান অনস্বীকার্য। তবে বিভিন্ন সময় যেমন ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ বা ২৬/১১ মুম্বাই হামলার পরে তাদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিজেপি সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিরক্ষা খাতে বড় অগ্রগতি এনেছে। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক, রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনা—এইসব পদক্ষেপ নিরাপত্তা ইস্যুতে দৃঢ় মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়। তবে সমালোচকেরা বলেন, নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কখনো কখনো অতিরিক্ত প্রচারণার অংশ করে ফেলা হয়।
তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক দল হলেও জাতীয় রাজনীতিতে এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও রাজ্য রাজনীতিতে সীমিত হলেও, সীমান্তবর্তী রাজ্যে শাসন করার ফলে, নিরাপত্তা ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আবার, অনুপ্রবেশ ইস্যুতে কড়া অবস্থান না নেওয়ার জন্য এই দলও সমালোচনার মুখে পড়েছে।
সিপিআইএম এবং অন্যান্য বাম দলগুলি ঐতিহাসিকভাবে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছে। তারা অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমানোর পক্ষে, যা এক দিক দিয়ে বাস্তবসম্মত হলেও, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রতিরক্ষা দুর্বল রাখার ঝুঁকিও তৈরি করে।
দেশরক্ষা শুধু সেনার দায়িত্ব নয়
আমরা প্রায়ই ধরে নিই, সেনা বাহিনী দেশের রক্ষাকবচ। বাস্তবে, দেশের প্রতিরক্ষা শুধু সেনার হাতে নয়, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নির্ভর করে। পররাষ্ট্রনীতি, অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ব্যবস্থাপনা, সাইবার নিরাপত্তা, সন্ত্রাসদমন—এসব বিষয়েও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সীমান্তে উত্তেজনা, পাকিস্তান ঘাঁটি থেকে পরিচালিত সন্ত্রাসবাদ, কিংবা দেশের অভ্যন্তরে নকশাল-সহ বিদ্রোহ দমন—এসব ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতি নয়, জাতীয় ঐক্য জরুরি। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে অনেক সময় এসব সংকটকেও বিভাজনের অস্ত্র বানানো হয়।
দেশপ্রেমের রাজনীতি: সীমা ও সম্ভাবনা
রাজনীতি ও দেশপ্রেমের সংমিশ্রণ সর্বদা নেতিবাচক নয়। এটি নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা, আত্মমর্যাদা ও জাতীয় দায়বোধ বাড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সেনাদের জন্য কল্যাণ প্রকল্প, শহীদ পরিবারের পাশে থাকা, জাতীয় পতাকা বা জাতীয় সংগীতের মর্যাদা রক্ষা—এইসব উদ্যোগ রাজনীতিকদের নেতৃত্বেই বাস্তবায়িত হয়।
তবে এই দেশপ্রেম যখন প্রতিপক্ষকে ‘দেশদ্রোহী’ ট্যাগ দিয়ে রাজনৈতিক লাভের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন সেটা বিপজ্জনক। বিরোধী মত মানেই রাষ্ট্রবিরোধী নয়—এমন উপলব্ধি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে থাকা উচিত।
জাতীয় স্বার্থে সংহতির প্রয়োজন
বিশ্বের উন্নত গণতন্ত্রগুলোতে, যেমন আমেরিকা বা ব্রিটেনে, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে শাসক ও বিরোধী এক কণ্ঠে কথা বলে। ভারতে সেই সংহতি এখনও দুর্বল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ছোট করার প্রবণতা জাতীয় স্বার্থে একতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর বা গালওয়ান সংঘর্ষের পর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় আমরা দেখি একাংশ সরকারকে দোষারোপ করছে, আর অন্য অংশ বিরোধী দলকে দেশদ্রোহী বলছে। এই মনোভাবের পরিবর্তন না হলে, নিরাপত্তা প্রশ্নে শক্তিশালী নীতি তৈরি করা কঠিন।
শিক্ষা ও নাগরিক চেতনায় দেশপ্রেম
দেশপ্রেমের শিক্ষা পরিবার ও বিদ্যালয় থেকেই শুরু হওয়া উচিত। শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও নাগরিক কর্তব্য সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করা গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশাত্মবোধক ও নাগরিক মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্ত করা।
উপসংহার
দেশরক্ষা ও দেশপ্রেম কেবল শব্দ নয়—এটি প্রতিটি নাগরিক ও রাজনৈতিক দলের প্রতি একটি নৈতিক দায়িত্ব। রাজনৈতিক মতভেদ থাকবেই, তবে জাতীয় স্বার্থে ঐক্য অপরিহার্য। দেশ যদি নিরাপদ না থাকে, তাহলে কোনও রাজনৈতিক বিজয় দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
তাই সময় এসেছে রাজনৈতিক দলগুলো যেন দেশরক্ষাকে দলীয় হাতিয়ার না বানিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগে, পরস্পরকে সম্মান জানিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব নেয়। কারণ শেষ কথা—"দেশ প্রথম, দল পরে"।