রায় বিপ্লব
“দেশরক্ষা” ও “দেশপ্রেম”—এই শব্দদ্বয় কেবল আবেগ নয়, এগুলো একটি জাতির অস্তিত্ব ও মর্যাদার ভিত্তি। যখনই জাতি বিপদের মুখে পড়ে, তখন সকল রাজনৈতিক মতাদর্শকে অতিক্রম করে দেশের পাশে দাঁড়ানো উচিত সব দলের। কিন্তু কিছু রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে তৃণমূল কংগ্রেস, এই মৌলিক দায়বদ্ধতা থেকে বারবার সরে এসেছে। মুখে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বুলি আওড়ালেও জাতীয় নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ বিরোধিতা ও সীমান্ত রক্ষা সংক্রান্ত ইস্যুতে তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।
সার্জিকাল স্ট্রাইক ও বালাকোটের সময় তৃণমূলের অস্পষ্ট অবস্থান
২০১৬ সালের সার্জিকাল স্ট্রাইক ও ২০১৯ সালের বালাকোট এয়ারস্ট্রাইক—এই দুই অভিযানে যখন সারা দেশ সেনাবাহিনীর সাহসিকতাকে কুর্নিশ জানাচ্ছিল, তখন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা পক্ষ নেওয়ার বদলে সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য ছিল—“প্রমাণ দিন, কোথায় কী হয়েছে?” একজন মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া শুধু সেনাবাহিনীর মনোবল ভাঙে না, বরং জাতীয় ঐক্যকেও দুর্বল করে।
বাংলাদেশ সীমান্ত ও অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে নরম মনোভাব
পশ্চিমবঙ্গ একটি আন্তর্জাতিক সীমান্ত রাজ্য। বহুদিন ধরেই এখানে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ বড় একটি সমস্যা। জাতীয় নিরাপত্তা, ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন এবং ভোটব্যবস্থার স্বচ্ছতা এই অনুপ্রবেশের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ তৃণমূল কংগ্রেস বরাবর এই বিষয়ে উদাসীন থেকেছে—অনেক ক্ষেত্রে এই অনুপ্রবেশকারীদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগও উঠেছে।
তৃণমূলের তরফে বারবার বলা হয়েছে—“মানবিক দিক থেকে দেখতে হবে।” অথচ প্রশ্ন হলো, দেশের আইন ভেঙে যারা অনুপ্রবেশ করছে, তারা যদি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পায়, তবে আইনের মর্যাদা কোথায় থাকে? তৃণমূলের এই মনোভাব কার্যত জাতীয় স্বার্থবিরোধী।
এনআরসি ও সিএএ নিয়ে দেশবিরোধী বিভ্রান্তি ছড়ানো
জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস এক বিশৃঙ্খল আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। সিএএ-র উদ্দেশ্য ছিল—ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের শিকার হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং পারসিদের নাগরিকত্ব দেওয়া। অথচ তৃণমূল এটিকে 'বর্ণবিদ্বেষী' এবং 'ভাগ করার রাজনীতি' বলে আখ্যা দেয়।
তৃণমূলের আন্দোলন এতটাই চরমে ওঠে যে তারা জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে সিএএ বিরোধী মিছিল করে—এমনকি 'ভারত বাঁচাও' স্লোগানের সঙ্গে দেশবিরোধী বক্তব্য মিলিয়ে দেয়। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং কট্টরপন্থীদের উৎসাহিত করে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয় যা দেশের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার পরিপন্থী।
জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সংস্কৃতিগত বিভাজন
তৃণমূল কংগ্রেস বাংলায় বারবার “বাঙালিয়ানা” ও “বাংলা বনাম দিল্লি” দ্বন্দ্বকে উসকে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ—even যদি তা সেনাবাহিনী বা দেশরক্ষার পক্ষে হয়—তাও তারা “বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ” বলে চিহ্নিত করেছে। এইভাবে তারা 'জাতীয়তাবাদ বনাম আঞ্চলিকতা'-র এক ভুল যুক্তি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
আসলে দেশপ্রেম এক সার্বিক চেতনা—যেটা ভাষা, অঞ্চল বা ধর্মের গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে না। তৃণমূল এই আঞ্চলিকতা-জাতীয়তার সংঘাত তৈরি করে নিজেকে “বাংলার রক্ষক” হিসেবে তুলে ধরতে চাইলেও বাস্তবে তারা জাতীয় ঐক্যের ভিত দুর্বল করছে।
সন্ত্রাসবাদ বিরোধিতায় দুর্বলতা
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যখন জিহাদি মৌলবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে, তখন তৃণমূল কংগ্রেসের নীরবতা বা নমনীয়তা উদ্বেগজনক। এমনকি কিছু ঘটনায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, রাজ্যের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং পুলিশ প্রশাসনের উপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বেড়েছে।
মালদা, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান প্রভৃতি জেলায় বিস্ফোরণ ও জঙ্গি ঘাঁটি আবিষ্কারের পরেও মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া বরাবর ছিল আত্মরক্ষামূলক। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা প্রশ্নে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হস্তক্ষেপ হলে বরং তা ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ বলে দেগে দেন। এতে প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে থেকে যায় এবং জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।
ভারতীয় সেনার প্রতি উপেক্ষা ও সন্দেহের মনোভাব
সেনাবাহিনী যখন দেশের জন্য প্রাণ দেয়, তখন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানো রাষ্ট্রের ন্যূনতম দায়িত্ব। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতিতে এই কৃতজ্ঞতা বা শ্রদ্ধার প্রকাশ প্রায় অনুপস্থিত। সেনাদের কাজে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খোঁজা, তাদের অভিযানে সন্দেহ প্রকাশ করা, শহিদদের প্রতি রাজনৈতিক চুপচাপ শ্রদ্ধা—এসবই দলটির জাতীয় ভাবনার দৈন্যতা স্পষ্ট করে।
২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য ছিল—“বিজেপি ভোটের জন্য যুদ্ধ চাইছে।” এমন বক্তব্য শুধুমাত্র অপমানজনক নয়, এটি সেনার আত্মত্যাগকে অপমান করার শামিল।
ছাত্র ও যুবদের মধ্যে দেশপ্রেম নয়, প্রতিবাদকে উৎসাহ
রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে তৃণমূল-সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যকলাপ প্রায়শই বিতর্কিত। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শহিদ দিবস পালনে বাধা কিংবা ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগানের বিরোধিতা—এসব ঘটনা এক অসুস্থ রাজনৈতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ।
ছাত্রদের প্রতিবাদ শেখানো ভাল, কিন্তু যদি সেই প্রতিবাদ জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা আত্মবিরোধিতা ছাড়া কিছু নয়। তৃণমূল কংগ্রেস এই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
বিপদের সময় কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাত, সহযোগিতা নয়
কোভিড, বন্যা বা সীমান্ত উত্তেজনার মতো সংকটের সময়ে রাজ্য ও কেন্দ্রের সমন্বয় অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু তৃণমূল সরকার বারবার কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টার নামতে দেওয়া হয়নি, কেন্দ্রীয় দলকে কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়েছে, এমনকি বিপর্যয়ের সময়ও রাজনৈতিক বাক্যবাণে কেন্দ্রকে দোষারোপ করা হয়েছে।
এইসব আচরণ প্রমাণ করে, তৃণমূল কংগ্রেস সংকটের মুহূর্তেও সহযোগিতার বদলে সংঘাতকেই রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে।
তৃণমূল কংগ্রেস বারবার রাজ্যীয় স্বার্থ ও জাতির স্বার্থের পার্থক্য বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশরক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা ও সীমান্ত সুরক্ষার মতো ইস্যুগুলোতে তাদের ভূমিকা চুপচাপ, দ্ব্যর্থক ও রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দেশপ্রেম তাদের কাছে একটি রাজনৈতিক ফ্রেমওয়ার্ক, যেখানে কেন্দ্রের বিরোধিতা করলেই নিজেকে "জনগণের পক্ষ" বলা যায়।
কিন্তু আজকের প্রজন্ম দেশপ্রেমকে আবেগ নয়, কর্তব্য হিসেবে দেখে। তারা জানে—দেশকে ভালোবাসা মানে শুধু ভোটে জেতা নয়, মানে শত্রুর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো।
তৃণমূল কংগ্রেস যদি সত্যিই জনসেবায় বিশ্বাস করে, তবে তাদের উচিত হবে সংকীর্ণ ভোটব্যাংক রাজনীতি ছেড়ে জাতীয় স্বার্থে অবস্থান নেওয়া। কারণ দেশরক্ষা কোনো রাজনৈতিক দল নয়—এটি ভারতের প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব।