পিয়া রায়
বুদ্ধপূর্ণিমা, বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত এক পবিত্র দিন, যাকে 'বৈশাখী পূর্ণিমা' নামেও অভিহিত করা হয়। এই দিনটি শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্যই নয়, মানবতার পক্ষেও এক গুরুত্বপূর্ণ দিবস। কারণ, এই দিনেই ঘটেছিল তিনটি অসাধারণ ঘটনা—গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বোধিলাভ (জ্ঞানপ্রাপ্তি), এবং মহাপরিনির্বাণ। একেই বৌদ্ধরা বলেন ‘ত্রিস্মৃতি বিজড়িত পবিত্র দিবস’।
গৌতম বুদ্ধের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দে বর্তমান নেপালের লুম্বিনী নামক স্থানে। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ ছিলেন এক রাজপরিবারের সন্তান। কিন্তু পৃথিবীর দুঃখ-কষ্ট, রোগ, জরা ও মৃত্যুর দৃশ্য তাঁকে বিচলিত করে তোলে। বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে তিনি বেরিয়ে পড়েন সত্য ও মুক্তির সন্ধানে। এক দীর্ঘ সাধনার পর বোধগয়ায় বোধিবৃক্ষের নিচে গভীর ধ্যানে স্থিত হয়ে তিনি অর্জন করেন পরম জ্ঞান—যা তাঁকে ‘বুদ্ধ’ বা ‘বোধপ্রাপ্ত’ করে তোলে।
বুদ্ধের জীবন ছিল মানবতাবাদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি মানুষকে ধর্ম বা জাতি নির্বিশেষে সহানুভূতি, দয়া, এবং অহিংসার পথ দেখিয়েছেন। তাঁর শিক্ষা ছিল সহজ, বাস্তবমুখী ও চিরন্তন। তিনি বলেছিলেন—“আপনি নিজেই আপনার পরিত্রাতা”, অর্থাৎ আত্মজ্ঞানই মুক্তির পথ। চারটি আর্যসত্য (চতুরার্য সত্য) এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গ তাঁর দর্শনের মূলে। দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি মধ্যম পথের উপদেশ দেন, যেখানে কোনো চরম ভোগ বা কঠোর তপস্যার স্থান নেই।
বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বৌদ্ধ মন্দিরগুলো সেজে ওঠে পূজার্চনা ও প্রার্থনায়। ভোরবেলা পতাকা উত্তোলন, বুদ্ধমূর্তিতে পুষ্পাঞ্জলি, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, ধ্যান ও ধর্মপাঠের মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়। অনেক স্থানে বুদ্ধের জীবনের উপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী, আলোচনা সভা ও শান্তি মিছিলের আয়োজন করা হয়। নানান ধর্ম ও জাতির মানুষ এই দিনে বুদ্ধের শান্তিপূর্ণ শিক্ষাকে স্মরণ করে ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
আজকের অস্থির পৃথিবীতে বুদ্ধের আদর্শ আগের চেয়েও প্রাসঙ্গিক। যেখানে হিংসা, লোভ ও বিদ্বেষ মানবসভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলছে, সেখানে বুদ্ধের অহিংসা, সংযম, ও সহমর্মিতা আমাদের একমাত্র দিশারি হতে পারে। বুদ্ধপূর্ণিমা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এক বিশ্বজনীন উপলক্ষ—মানবতার, প্রজ্ঞার, ও শান্তির।
এই পূর্ণিমায় তাই আমরা যেন কেবল প্রার্থনা করেই থেমে না থাকি, বরং বুদ্ধের শিক্ষা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করি। তবেই প্রকৃত অর্থে আমরা বুদ্ধপূর্ণিমাকে শ্রদ্ধা জানাতে পারব।