বটুকৃষ্ণ হালদার
এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর, যিনি কাশ্মীরে যাননি। অন্যদিকে এমন বাঙালিকেও খুঁজে বের করা খুব দুষ্কর, যিনি জানেন কেন আজ কাশ্মীরে ভারতবাসী হিসেবে তাঁকে পাসপোর্ট, ভিসা বা নিদেনপক্ষে পারমিট নিয়ে যেতে হয় না। ৮ই এপ্রিল ১৯৫০ - নেহরু লিয়াকৎ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। সেদিনই ঐ চুক্তি র প্রতিবাদে ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯শে এপ্রিল ১৯৫০ শ্যামাপ্রসাদ পার্লামেন্টে তাঁর পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করে যে বিবৃতি দেন তার প্রতিটি ছন্দে ফুটে উঠেছিল তাঁর সাবলীল ব্যক্তিত্ব, তীব্র দেশপ্রেম, অজেয় ইচ্ছাশক্তি আর দুর্জয় সাহস। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন--
"কোন ব্যক্তিগত কারণ আমাকে পদত্যাগ করতে প্রণোদিত করেনি। আমি আশা করি, যাদের সাথে আমার মত বিরোধ হয়েছে, তাঁরাও আমার এই conviction-কে সমর্থন করবেন। আমার পদত্যাগের কারণ সম্পূর্ণ মৌলিক এবং আমি মনে করি, যে সরকারের নীতি আমি অনুমোদন করি না সেই সরকারের একজন সদস্য হয়ে থাকা অনুচিত এবং অসম্মানজনক।
"আমি মনে করি এই নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি মূল সমস্যার বিন্দুমাত্র সমাধান করবে না। ওই দেশ থেকে সমস্ত হিন্দু শিখকে তাড়িয়ে দিয়ে এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, একই ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে ইসলামিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা পাকিস্তানের জাতীয় নীতি। এই নীতির ফলে পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে"NASTY BRUTISH AND SHORT"। আমাদের ইতিহাসের শিক্ষা থেকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। যদি কেউ পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস স্মরণ করেন তবে বুঝতে পারবেন যে, সেখানে হিন্দুদের পক্ষে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। সমস্যাটা সাম্প্রদায়িক নয়, প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক। এই চুক্তি দুঃখজনকভাবে ইসলামিক রাষ্ট্রের অর্থ কি হতে পারে তা এড়িয়ে গেছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই চুক্তির এক জায়গায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, the principles of democracy. freedom. equality. tolerance and special justice as enunciated by Islam shall be fully observed। তিনি বলেছেন, ইসলাম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং আচার-আচরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলামে দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা এবং তা প্রতিকারের উপায় বিশেষভাবে নির্দিষ্ট।
"আমি গুরুত্ব সহকারে এই প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই, এই ধরনের সমাজে কোন হিন্দু তাঁর সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে নিরাপদ বোধ করতে পারেন কিনা?"
নেহরুকে তিনি সরাসরি আহ্বান জানিয়ে বলেন-- "যারা এই চুক্তিকে সমর্থন করছেন তাঁদের কাছে আমার শ্রদ্ধাপূর্ণ মিনতি, আপনারা পূর্ব পাকিস্তানে যান; একলা নয়, স্ত্রী, ভগ্নি ও কন্যাদের নিয়ে ওখানে সাহসের সাথে হতভাগ্য হিন্দু সংখ্যালঘুদের সাথে বসবাস করুন। তবে তো হবে এই চুক্তির প্রতি আপনাদের বিশ্বাসের সত্তিকারের পরীক্ষা"। (I would only respectfully urge those who believe in the agreement to discharge their responsibility by going to East Bengal - not alone, but accompanied by their wives, sisters and daughters and bravely share the burden of joint living with the unfortunate Hindu minorities of East Bengal)।"
ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি পদত্যাগ করলেন। আলোড়ন সৃষ্টি হল রাজনৈতিক মহলে। তবে কি শ্যামাপ্রসাদ রাজনীতি ছেড়ে দিলেন। কারণ তিনি তাঁর ভাষণে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে আত্মনিয়োগের কথা বারবার বলেছিলেন।
অনেকেই প্রশ্ন করলেন, তবে কি জহরলাল নেহরুর একচ্ছত্র আধিপত্য মেনে নেওয়া হবে?
কিন্তু অচিরেই ভুল ভাঙ্গে সবার। শ্যামাপ্রসাদ এর নেতৃত্বে এক নতুন রাজনৈতিক দল জন্ম নেয় - জনসংঘ।
নতুন দলের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শ্যামাপ্রসাদ জানালেন," কংগ্রেসের শাসনের মধ্যে যে একনায়তান্ত্রিক মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে তার অন্যতম কারণ দেশে কোনো সুসংগঠিত বিরোধীদল নেই (one of the chief reasons for the manifestation of dictatorship of Congress rule is the absence of well organised opposition parties)।"
স্বাভাবিকভাবেই এই নতুন পার্টি কে ভালোভাবে নিলেন না নেহরু। হুংকার ছাড়লেন," I will crush Janasangha"
উত্তর দিলেন শ্যামাপ্রসাদ - "I say, I will crush this crushing mentality:
জনসংঘের বিরুদ্ধে রুটিনমাফিক অভিযোগ আনলেন নেহরু, "সাম্প্রদায়িক"। বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন শ্যামাপ্রসাদ,' "স্বাধীনতার আগে মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বেদীতে বারবার ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কে বলি দিয়ে এবং দেশভাগের পরেও পাকিস্তানের খেয়াল এর কাছে যিনি আত্মসমর্পণ করেন, সেই নেহরুর অন্যকে সাম্প্রদায়িক অভিযুক্ত করা মানায় না। এখন একমাত্র নেহরু এবং তার সাকরেদরা ছাড়া দেশে আর কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই। আগামী নির্বাচনে মুসলমান ভোট পাওয়ার আশায় তাঁরাই এই নীতি নিয়েছেন। দেশের অন্যান্য সমস্যা থেকে দেশের মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুলেছেন। (The cry of communalism raised by Pandit Nehru is to sidetrack the real issues now before the country)"।
নেহরুর কাশ্মীরে নীতির তীব্র সমালোচনা করেন শ্যামাপ্রসাদ। পার্লামেন্টে শ্যামাপ্রসাদের ভাষনের মাঝখানে চিৎকার করে ওঠেন অসহিষ্ণু নেহরু - "I know more about Kashmir then Mukharji"
জবাব দেন শ্যামাপ্রসাদ - "এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা যে প্রধানমন্ত্রী জগতের সবকিছুই সকলের থেকে বেশি জানেন এবং বোঝেন আর তাই তিনি করো পরামর্শ নেন না। তাহলে আমি জানতে চাই, কাশ্মীরীরা প্রথমে ভারতীয় পরে কাশ্মীরী না প্রথমে কাশ্মীরী পরে ভারতীয়। এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং আমাদের অবশ্যই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। (Are Kashmiris Indians first and Kashmiris next or they are Kashmiris first and Indians next or they are Kashmiris first, second and third and not Indians at all)।"
১৯৪৭ সালের ২৬ শে অক্টোবর জম্মু-কাশ্মীর ভারতের যোগদান করে। এই যোগদান ছিল সম্পূর্ণ শর্তহীন। কিন্তু আগ বাড়িয়ে হঠাৎ নেহরু কাশ্মীরের জন্য কিছু সুযোগ সুবিধা ঘোষণা করেন। প্রস্তাব দেওয়া হয়, কাশ্মীরের জন্য আলাদা আইন, আলাদা পতাকা এবং আলাদা প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। এই প্রস্তাবকে সাংবিধানিক রূপ দেওয়ার জন্য সংবিধানে ৩৭০ ধারা বলে একটি বিশেষ ধরাও সংযুক্ত করা হয়।
নেহরুর এই অবিমৃষ্যকারিতায় ক্ষুব্দ শ্যামাপ্রসাদ নেহরু সম্পর্কে মূল্যায়ন করেন -"When I scan the whole course of Indian history, I do not find a single man who has done more harm to this country than Pandit Nehru"
শ্যামাপ্রসাদ নেহরুর এই কাশ্মীর নীতির তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাঁর সিংহ গর্জন 'এক প্রধান' 'এক নিশান' 'এক বিধান' সমগ্র দেশে ধ্বনিত হতে থাকে। ওই সময় কাশ্মীর যেতে পারমিট লাগত। অর্থাৎ সরকারি অনুমতি নিয়ে তবেই কাশ্মীর যাওয়া যেত। শ্যামাপ্রসাদ নিজে এই প্রথা ভেঙে কাশ্মীর যাওয়ার সংকল্প নেন। এই প্রসঙ্গে নেহরু কে লেখা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি এখানে উল্লেখের দাবি রাখে।
"আমি আপনাকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে চাই যে, আপনার ক্রোধ এবং আক্রোশের সম্মুখীন হতে আমরা প্রস্তুত। গতকাল পাঞ্জাবে নিবর্তনমূলক আটক আইন আমাদের কর্মীদের গ্রেপ্তার করে আপনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে কি হতে চলেছে। আমাদের দেশের গণতন্ত্রের এক অদ্ভুত প্রতিফলন আপনার কাছে দেখা গেল, যেখানে আইনসিদ্ধ রাজনৈতিক বিরোধিতা দমন করতে নিবর্তনমূলক আটক আইন প্রয়োগ করা হল।
" আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন যে আপনার মত কাশ্মীর সমস্যা আন্তর্জাতিককরন ব্যাপারটা আমি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। তবে এই দাবি কোন একজনও করবে না যে, আপনার কাশ্মীর নীতি পরিচালনা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের সম্মান একটুও বাড়িয়েছে বা বিপুল আন্তর্জাতিক সমর্থন আমরা পেয়েছি।"সর্বশেষে একজন দেশপ্রেমিকের তাঁরই বিরোধীকে আহ্বান -
"আমাদের মধ্যে নীতিগত বিরোধ থাকলও আমরা একই মায়ের দুই সন্তান। আসুন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে আমরা সমস্ত রকম মর্যাদার লড়াই থামিয়ে এই সমস্যার একটা সুষ্ঠু সমাধানের চেষ্টা করি।"
কিন্তু নেহরু শুনলেন না। তাঁর কাছে দেশের থেকেও তাঁর ব্যক্তিগত ইগো এবং মুসলমান তাস খেলা ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ।২৫ শে এপ্রিল, ১৯৫৩, কলকাতা থেকে দিল্লিতে উড়ে গিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। যাবেন কাশ্মীর। নেহরু-আব্দুল্লাহ র গড়ে তোলা বিজাতীয় নীতি ভেঙ্গে ফেলবেন তিনি। ভেঙেছিলেনও। কিন্তু দেখে যেতে পারেননি। আজ ২৩শে জুন ২০২০। জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অস্তিত্বও আর নেই। ১৯৫৩ সালের এই ২৩ শে জুন দিনটিতেই হত্যা করা হয়েছিল ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে।পন্ডিচেরি থেকে শ্রীমা ও দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন "unfortunately he was killed"।
শ্যামাপ্রসাদের এই অকাল প্রয়াণে শ্রদ্ধায়, দুঃখে, মর্মবেদনায় নির্বাক হয়ে গিয়েছিল আপামর জনসাধারণ।এক জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদ মাধ্যমে(২৪.০৬.১৯৫৩)য় লেখা হয়েছিল-" অপরাহ্ন তিনটার মধ্যে নরনারী ও শিশুর এক বিরাট জনতা দমদম বিমান ঘাঁটিতে উপস্থিত হয়
" কলিকাতা হইতে দমদম বিমান ঘাটি পর্যন্ত নয়মাইল দীর্ঘ পথের উভয় পাশে গ্রিয়েরসন মুখে গৃহের সম্মুখে অলিন্দে এবং পারশে আগ্রহাকুল জনতা সমবেত হয় এবং দমদমের দিক হইতে আগত প্রত্যেকের নিকট ডক্টর মুখোপাধ্যায়ের বিমান কখন আসিবে প্রশ্ন করিতে থাকে।তিনটা হইতে ছয়টা, ছয়টা হইতে সাড়ে সাতটা, সাড়ে সাতটা হইতে নয়টা - বিমান আসিবার সময় কেবলই পিছাইয়া যাইতে লাগিল। তথাপি এই বিরাট জনসমুদ্র প্রতীক্ষারত হইতে চ্যুত হইল না।অবশেষে দেহ দমদমে পৌঁছাইল।
"রাত্রি নয়টা বাজিবার পাঁচ মিনিট পূর্বে ডক্টর মুখোপাধ্যায়ের শবদেহ বহন করিয়া একখানি আই.এন.এ. বিমান দমদম বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করে।বেলা তিনটা হইতে এই বিপুল জনতা অশেষ ধৈর্য সহকারে প্রতীক্ষা করিতেছিল। জনতার ভিড় এত বেশি হইয়া ছিল যে বিমান অবতরণ ক্ষেত্রের প্রবেশ পথে পুলিশকে এক কঠিন বেষ্টনী রচনা করিয়া শৃঙ্খলা রক্ষা করিতে হয়
"রাত্রি প্রায় নয়টার সময় দমদম বিমান ঘাঁটি হইতে শোভাযাত্রা ডক্টর মুখোপাধ্যায়ের শবানুগমন করিয়া কলিকাতা অভিমুখে অগ্রসর হইতে থাকে। শোভাযাত্রাটি যতই কলিকাতার নিকটবর্তী হইতে থাকে, ততই লোকে লোকে ভরিয়া যাইতে থাকে। পথের দুই ধারে অগণিত লোক - পুরুষ, নারী, আবালবৃদ্ধবনিতা আকুল নয়নে ডক্টর মুখোপাধ্যায়ের শবদেহর দিকে চাহিয়া থাকে। বাড়ির বারান্দা, গাছের উপর, ছাদে সর্বত্র লক্ষ লক্ষ লোক ডক্টর মুখোপাধ্যায় কে শেষবারের মতো দর্শন করিবার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করিয়া থাকে। শ্যামবাজার মোড়ে লক্ষাধিক নর-নারী গভীর রাত্রি পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়া থাকে"সজল চোখে চপলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রশ্ন করেন - "কেমন করিয়া জনসাধারণের চিত্তে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ এমন দৃঢ়ভাবে আসন প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন?"
