যোগমায়া আচার্য
২৯ জুলাই—International Tiger Day। এই দিনটি বিশ্বব্যাপী একমাত্র উদ্দেশ্যেই পালন করা হয়—বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং আমাদের এই মহারাজ বন্যপ্রাণীকে পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা। বাঘ শুধুমাত্র একটি বন্যপ্রাণী নয়, এটি শক্তি, সৌন্দর্য, নির্ভীকতা ও ভারসাম্যের প্রতীক। আমাদের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার ভারসাম্য রক্ষায় বাঘের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, মানুষের লোভ, বন উজাড় এবং বেআইনি শিকার এই দুর্জয় প্রাণীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এক সময় বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ বাঘ ছিল। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, চীন, রাশিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে বাঘের গর্জন শোনা যেত। কিন্তু বিগত এক শতাব্দীতে বাঘের সংখ্যা ৯৫ শতাংশ কমে গেছে। বাঘ প্রজাতির অন্তত তিনটি উপপ্রজাতি ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে—বালি টাইগার, ক্যাস্পিয়ান টাইগার এবং জাভান টাইগার। বর্তমানেও সাইবেরিয়ান, বেঙ্গল, ইন্দোচাইনিজ, মালয়ান ও সুমাত্রান বাঘ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস আমাদের একটিবার হলেও থেমে ভাবতে শেখায়—আমরা কি যথেষ্ট চেষ্টা করছি এই রাজার প্রাণ রক্ষা করতে?
ভারত বিশ্বে বাঘের সবচেয়ে বড় আবাসভূমি। ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ঠিক হয়, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে কাজ করা হবে—যা "TX2" নামে পরিচিত। ভারত সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে অনেকাংশে সফল হয়েছে। ২০১८ সালের জাতীয় বাঘ গণনা অনুযায়ী, ভারতের বনে বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২,৯৬৭—যা বৈশ্বিক সংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ। কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্র, এবং পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চল এই প্রাণীর প্রধান আশ্রয়স্থল। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার সমুদ্র-নদী-জঙ্গলের এক বিরল জীবনচক্রের প্রতীক।
তবে শুধু সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, প্রয়োজন বাঘের টেকসই ও নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করা। বনাঞ্চল কমে আসা, জলবায়ু পরিবর্তন, মানব-প্রাণী সংঘর্ষ এবং চোরাশিকার বাঘের টিকে থাকার প্রধান বাধা। বন উজাড় হওয়ায় বাঘের চারণভূমি সংকুচিত হয়েছে, ফলে তারা মানুষের বসতিতে ঢুকে পড়ছে। এতে মানুষ বাঘকে শত্রু মনে করছে, আতঙ্কে হত্যা করছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কালোবাজারে বাঘের চামড়া, দাঁত, হাড় ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চাহিদা বেড়ে চলেছে। এই সবই বাঘ সংরক্ষণের পথকে আরও কঠিন করে তুলছে।
তবে সব অন্ধকারে আশার আলোও রয়েছে। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংস্থাগুলোর উদ্যোগে বহু সংরক্ষণ প্রকল্প গড়ে উঠেছে। যেমন ভারতের ‘প্রজেক্ট টাইগার’, WWF-এর সংরক্ষণ কার্যক্রম, NTCA-এর সক্রিয় উদ্যোগ ইত্যাদি। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে আজ বাঘের চলাচল নজরে রাখা সম্ভব হয়েছে। ক্যামেরা ট্র্যাপ, জিপিএস কলার, ড্রোন নজরদারি—এসব প্রযুক্তি বাঘ সংরক্ষণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। স্কুল-কলেজেও পরিবেশ শিক্ষার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে বাঘের গুরুত্ব বোঝানো হচ্ছে।
কিন্তু শুধুমাত্র প্রশাসনিক বা পরিবেশবিদদের দায় নয়—বাঘ বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের সবার। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বন ও প্রাণীসম্পদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণই বাসযোগ্য পৃথিবীর অংশ। বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেলে শুধু একটি প্রাণীরই অবসান হবে না, পুরো খাদ্যশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে, বন ধ্বংস হবে, পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে উঠবে। যেমন, বাঘ বনের শিকারচক্রের শীর্ষে থাকে এবং সে যদি না থাকে, তাহলে হরিণ বা শূকর জাতীয় প্রজাতির সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যাবে, যার ফলে বনের গাছপালা ধ্বংস হবে, এবং তা জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলবে। তাই বলা হয়, “বাঘ বাঁচলে বন বাঁচবে, বন বাঁচলে মানুষ বাঁচবে।”
আন্তর্জাতিক বাঘ দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত—প্রতিজ্ঞা করা, আমরা কোনোভাবেই বাঘ বা তার আবাসস্থানের ক্ষতি করব না। সমাজে পরিবেশ-সচেতনতা ছড়িয়ে দেব, শিশুদের প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণীর প্রতি মমতা শেখাব। স্কুল-কলেজে বাঘ ও বন সংরক্ষণ নিয়ে কর্মশালা, আলোচনা ও প্রকল্পভিত্তিক কাজ বাড়ানো যেতে পারে। সংবাদমাধ্যম, সাহিত্য, সিনেমা ও সামাজিক মাধ্যমে বাঘের গুরুত্ব তুলে ধরাও অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশের এই রাজাকে নিয়ে আরও বেশি গল্প, তথ্যচিত্র, নাটক বা শিল্পকর্ম তৈরি হলে সাধারণ মানুষের মনের ভেতরেও তার জন্য ভালোবাসা বাড়বে।
আধুনিক সভ্যতা যেন অরণ্যের নীরব আহ্বান না উপেক্ষা করে। প্রকৃতি আমাদের পরম বন্ধু, আর তার হৃদয়ে শোভা পায় এই বিশাল বাঘ। যে প্রাণী একদিন ভারতীয় সভ্যতার প্রতীকে পরিণত হয়েছিল, সেই প্রাণী যেন আমাদের ভুলে বিলুপ্ত না হয়। তাকে রক্ষা করা মানেই আমাদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা। আর তাই, International Tiger Day কেবল একটি উদযাপন নয়, এটি আমাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়া এক বিশেষ দিন।
প্রকৃতিকে ভালোবাসুন, বাঘকে ভালোবাসুন—এই মন্ত্রে এগিয়ে চলুক আমাদের বিশ্ব।