পাঠক মিত্র
তিনি এ দেশে ধর্মকেন্দ্রিক জীবন থেকে মানবকেন্দ্রিক জীবন নিয়ে এসেছেন, শিখিয়েছেন আধুনিক ভারত গড়ে তোলার জন্য কি ধরনের শিক্ষা, কি ধরনের সংস্কৃতি, কি ধরনের জীবনবোধের চর্চা দরকার । জড়ত্বের অতল অন্ধকারে ডুবে থাকা একটা জনসমষ্টিকে তিনি শিখিয়েছেন কেমনভাবে মেরুদণ্ডের উপর ভর করে চলতে হয় । যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে হিরো । তিনি হলেন এ দেশে নবজাগরণের প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় । সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ সহ সমাজের প্রতিটি স্তরের নানা কুপ্রথার বিরুদ্ধে যাঁর আজীবন লড়াই আধুনিক ভারতের মননজগতের পথ তৈরি করেছিল । কোন মনীষীর মূল্যায়ন তাঁর সময়কে বাদ দিয়ে নয় । আর তাঁর সময়কে না ধরতে পারলে এই মূল্যায়নে অনেক ফাঁক থেকে যায় । আসলে কোন মনীষী তাঁর চিন্তা-ভাবনায়, কাজে সময়কে অতিক্রম করে বলেই না তিনি মনীষী । রামমোহন রায়ের সময়কে কবিগুরুর কথায় বলতে হয়, 'যখন আমাদের আর্থিক মানসিক আধ্যাত্মিক শক্তি ক্ষীণতম, যখন আমাদের দৃষ্টিশক্তি মোহাবৃত, সৃষ্টিশক্তি আড়ষ্ট, বর্তমান যুগের কোনো প্রশ্নের নূতন উত্তর দেবার মতো বাণী যখন আমাদের ছিল না, আপন চিত্তদৈন্য সম্বন্ধে লজ্জা করবার মতো চেতনাও যখন দুর্বল, সেই দুর্গতির দিনেই রামমোহন রায়ের এ দেশে আবির্ভাব।' কবি আরো বলেন, ' নবযুগের উদ্বোধনের বাণী দেশের মধ্যেই তিনিই তো প্রথম এনেছিলেন, সেই বাণী এই দেশেরই পুরাতন মন্ত্রের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল; সেই মন্ত্রে তিনি বলেছিলেন--- 'অপাবৃণু', হে সত্য, তোমার আবরণ অপাবৃত করো । ভারতের এই বাণী কেবল স্বদেশের জন্যে নয়, সকল দেশের সকল কালের জন্যে । এই কারণেই ভারতবর্ষের সত্য যিনি প্রকাশ করবেন তাঁরই প্রকাশের ক্ষেত্র সর্বজনীন ।
রামমোহন রায় হলেন সেই সর্বকালের মানুষ ।....তাঁর হৃদয় ছিল ভারতের হৃদয়ের প্রতীক--সেখানে হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান সকলে মিলেছিল তাদের শ্রেষ্ঠ সত্তায়, সেই মেলবার আসন ছিল ভারতের মহা ঐক্যতত্ত্ব 'একমেবা-দ্বিতীয়ম্' । কবি তাই তাঁকে বলেছেন, তিনিই ভারতপথিক ।
আর এই সময়ে রাজার জ্ঞানের জ্যোতি ও কর্মের উদ্যোম তখনকার সমাজে সতেজতার বীজ বুনে দিয়েছিল । অক্ষয়কুমার দত্ত বলেছেন,'তোমার জ্ঞান ও ধর্ম্মোৎসাহে উৎসাহিত হৃদয় জঙ্গলময়-পঙ্কিল-ভূমি পরিবেষ্টিত একটি অগ্নিময় আগ্নেয়গিরি ছিল; তাহা হইতে পূণ্য-পবিত্র প্রচুর জ্ঞানাগ্নি সতেজে উৎক্ষিপ্ত হইয়া চতুর্দ্দিকে বিক্ষিপ্ত হইতে থাকিত । তুমি বিজ্ঞানের অনুকূল পক্ষে যে সুগভীর রণবাদ্য বাদন করিয়া গিয়াছ, তাহাতে যেন এখনও আমাদের কর্ণ-কুহরে ধ্বনিত করিতেছে ।' অক্ষয়কুমার দত্তের এই লেখায় তাঁর মূল্যায়ন যেমন করেছেন তেমন রামমোহন রায়ের প্রতি তদানীন্তন এ দেশের মানুষের অবহেলা অবজ্ঞা থেকে বিরুদ্ধচারনাকে ধিক্কার জানিয়েছেন । বলেছিলেন, 'তিনি জীবদ্দশায় স্বদেশীয় লোককর্ত্তৃক নিগৃহীত হইয়া প্রত্যাশা করিয়াছিলেন, উত্তরকালীন লোক তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞ হইবে । কিন্তু একাল পর্য্যন্ত তাহার তাদৃশ কিছু দৃশ্যমান চিহ্ন প্রকাশ পায় নাই ।' অক্ষয়কুমার দত্ত আরো বলেছিলেন, "যদি রামমোহন রায়ের স্বদেশীয়বর্গের কতদূর অধঃপাত ঘটিতে পারে দেখিতে চাও, তবে আমাদের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত কর ! উত্তম পদার্থ কিরূপে অধম হয়, উচ্চাশয় কিরূপে নীচাশয় হয় ও মনুষ্যদেহ কিরূপে অমানুষের আধার হয়, তাহা একবার আমাদের প্রতি নেত্রপাত করিয়া দৃষ্টি কর । পর্ব্বত কিরূপে গহ্বর হয়, হীরক কিরূপে অঙ্গের হয় ও জ্বলন্ত কাষ্ঠ কিরূপে ভস্মরাশিতে পরিণত হয়, তাহা একবার এই বর্ত্তমান অকৃতজ্ঞ নরাধম জাতির প্রতি নেত্রপাত করিয়া দৃষ্টি কর !!!" রামমোহন রায়কে চেনার জন্য যে দৃষ্টিপাত থাকার কথা তার অভাবে এই নরাধম জাতির দিকে এমনভাবে অক্ষয়কুমার দত্ত নির্দেশ করলেন যেন এই নরাধম জাতির অধঃপতন তখনই শুরু হয়েছে । তবে এই অধঃপতনের ইতি আজও হয় নি ।
রাজা রামমোহনের কাজ ও তাঁর নবজাগরণের চিন্তা ভাবনার ঢেউকে পরবর্তী সময়ে যাঁরা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, ডিরোজিও এবং ম্যাক্সমুলার, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেন্দ্রলাল সরকার, কেশবচন্দ্র সেনের মত মানুষদের কথায় রামমোহনের মহত্ব থেকে সমাজ নিতে পারেনি । তাঁর ফার্সি রচনায় তাঁর বিশ্বজনীনতা, সত্যানুসন্ধানীর পরিচয় সার্ধদ্বিশতবর্ষ সময়ের পরেও আধুনিকতাকে অবশ্যই ব্যঙ্গ না-করে পারে না । তাঁর লেখার একটি অংশে তিনি মানব জাতিকে চার শ্রেণীতে ভাগ করা যায় বলে বলেছেন । 'প্রথম- একশ্রেণীর লোককে প্রতারক বলা যায়, যারা লোককে তাদের দলে টানবার জন্য ইচ্ছামত নানা মতবাদ, ধর্ম্মমত ও বিশ্বাস প্রভৃতি বানিয়ে প্রচার করে, লোককে কষ্ট দেয়, ও তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে । দ্বিতীয়-- আর এক শ্রেণীর লোককে প্রতারিত বলা যায়, যারা কোন সত্য খবর না করেই অন্যের দলে যোগ দেয় । তৃতীয়-- এক শ্রেণীর লোক, যারা প্রতারক এবং প্রতারিত । তারা অন্যের উক্তির বিশ্বাস করে এবং অপরকেও তা আঁকড়ে ধরতে প্ররোচিত করে । চতুর্থ---যারা ঈশ্বরের অনুগ্রহে প্রতারকও নয়, প্রতারিতও নয় ।' মানব জাতির এই চার শ্রেণী ভাগ যেন অন্যান্য সমস্ত ভাগাভাগির অন্তরালে আজ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে ।
আর পত্রাবলীর মধ্যে লর্ড আমহার্স্টকে লেখা পত্রটি শিক্ষাবিষয়ক তাঁর ভাবনা যা এখনও আমাদের ভাবতে হয় । তাঁর এই পত্রের সারমর্ম এই যে---"সংস্কৃত শিক্ষাপদ্ধতি দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রণোদিত । এই দেশে ইতিমধ্যেই দু'হাজার বছর ধরে এই শিক্ষা চলে আসছে । ব্রিটিশ সরকার হিন্দু পন্ডিতদের দিয়ে পুনরায় তা চালু করছে । যার ফলে মিথ্যা অহংকার জন্মাবে । অন্তঃসারশূণ্য চিন্তা, যেটা স্পেকুলেটিভ মানুষেরা করছেন, সেটাই বাড়বে । বেদান্ত শিক্ষার দ্বারা যুবকরা উন্নত নাগরিক হতে পারবে না । বেদান্ত যেটা শেখায় সেটা হচ্ছে, এই পরিদৃশ্যমান জগতের কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। উন্নততর ও উদার শিক্ষার জন্য প্রয়োজন অঙ্ক শাস্ত্র, প্রাকৃতিক দর্শন, কেমিস্ট্রি, অ্যানাটমি ও অন্যান্য কার্যকরী বিজ্ঞান শিক্ষা ।" তদানীন্তন সময়ে শিক্ষা নিয়ে তাঁর এই চিন্তা ও ভাবনা আজকের শিক্ষাপরিচালকদের ভাবায় না, যা আজকের শিক্ষানীতিতে তার প্রতিফলন দেখা যায় ।
নবজাগরণের পথিকৃৎ এই মানুষটির চর্চা আজও অত্যন্ত জরুরি ।