Select language to read news in your own language

ভাষার মানচিত্রে বিভাজিত ভারত: একভাষিক হিন্দি-বেল্ট বনাম বহুভাষিক ভারত


আর বিপ্লব

 

ভারতবর্ষ একটি ভাষিক বৈচিত্র্যের দেশ, যেখানে শতাধিক ভাষা ও সহস্রাধিক উপভাষা প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই দেশে কোনও একক ভাষার প্রাধান্য নেই, বরং একাধিক ভাষার সহাবস্থানের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। কিন্তু সাম্প্রতিক এক তথ্যে উঠে এসেছে এক চমকপ্রদ ও ভাবনার বিষয়—হিন্দি-বেল্টের রাজ্যগুলিতে ৯০%রও বেশি মানুষ কেবলমাত্র একটি ভাষায় কথা বলেন, যেখানে ভারতের অন্য রাজ্যগুলিতে মানুষ অনেক বেশি ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন বা বহুভাষিক। এই ভাষাভিত্তিক পার্থক্য কেবল সংখ্যা নয়, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে সাংস্কৃতিক মনোভাব, শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতিগত আত্মপরিচয়ের এক জটিল সম্পর্ক।

এই তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ভারতের হিন্দি বেল্ট—যেমন উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় ও হরিয়ানার মতো রাজ্যগুলিতে মানুষের মধ্যে অন্য ভাষা শেখার আগ্রহ তুলনামূলকভাবে কম। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারত, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি—যেমন তামিলনাড়ু, কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড কিংবা ওড়িশায়—মানুষ তুলনামূলকভাবে অধিক ভাষা জানেন এবং অন্য ভাষায় কথা বলতেও স্বচ্ছন্দ। প্রশ্ন উঠছে—এই বৈষম্যের কারণ কী?

খবরের আপডেট পেতে লাইক করুন সাতসকাল ফেসবুক পেজ  

প্রথমত, হিন্দি ভাষা ভারতে কেন্দ্রীয় ভাষার মর্যাদা পাওয়ায় হিন্দি-বলয়ের মানুষের একটি ভাষিক সুবিধা রয়েছে। তাঁরা মনে করেন তাঁদের ভাষাই ‘ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ অফ ইন্ডিয়া’। এই ধারণা তাঁদের মধ্যে অন্য ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা বা আগ্রহ কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ হিন্দিভাষীরা বিশ্বাস করেন, অন্যরা তাঁদের ভাষা শিখবে, তাঁদের অন্য ভাষা শেখার দরকার নেই। এই মনোভাবই একভাষিকতা বজায় রাখার অন্যতম সামাজিক কারণ।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থা। হিন্দি-বেল্টের রাজ্যগুলিতে বেশিরভাগ স্কুলে স্থানীয় ভাষা এবং ইংরেজি ছাড়া তৃতীয় ভাষা শেখার সুযোগ সীমিত। অন্যদিকে দক্ষিণ বা পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে ইংরেজি এবং হিন্দির পাশাপাশি স্থানীয় ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়, ফলে একজন ছাত্র ছোটবেলা থেকেই অন্তত তিনটি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠে। যেমন তামিলনাড়ুর একজন ছাত্র তামিল, ইংরেজি ও হিন্দি জানে; আবার পশ্চিমবঙ্গের কেউ বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি ও হিন্দি পড়ে। ফলে তাঁদের মধ্যে বহুভাষিকতার প্রবণতা তৈরি হয় ছেলেবেলা থেকেই।

তৃতীয়ত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদের, বিশেষত যারা কর্মসংস্থানের জন্য অন্য রাজ্যে যান, তাঁদের অনেক সময় হিন্দি শেখা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। এটি তাঁদের উপর চাপ সৃষ্টি করলেও তাঁরা এই চাপ থেকে শিক্ষালাভ করেন এবং নতুন ভাষা আয়ত্ত করেন। অন্যদিকে হিন্দি-বেল্টের মানুষের কর্মচাহিদা মূলত নিজেদের রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকায়, নতুন ভাষা শেখার প্রয়োজন হয় না। তাই তাঁদের ভাষিক জগৎ অনেকটাই সীমিত থেকে যায় এবং নতুন ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা বা আগ্রহ গড়ে ওঠে না।

চতুর্থত, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতীয়তাবাদের বর্ণনাও ভাষিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হিন্দি-বেল্টের রাজ্যগুলিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শের প্রসার ঘটেছে, যেখানে হিন্দি ভাষাকে "রাষ্ট্রীয় ঐক্য"-এর প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এই চিন্তাধারা অনেকক্ষেত্রে অন্য ভাষার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি করে এবং তা একপ্রকার ভাষিক আত্মমগ্নতার জন্ম দেয়। ফলে স্থানীয় মানুষ ভাবেন, অন্য ভাষা শেখার মানে যেন তাঁদের সাংস্কৃতিক পরিচয় থেকে সরে আসা। এই ধারণা অচেতনভাবে হলেও বহুভাষিকতার পথে বাধা তৈরি করে।

অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারত কিংবা উত্তর-পূর্ব ভারতের ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা অনেক শক্তিশালী। তামিল, কন্নড়, বাংলা, ওড়িয়া, অসমীয়া, মণিপুরি ইত্যাদি ভাষাগুলি কেবল ভাষা নয়, সেখানকার মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই রাজ্যগুলিতে নিজেদের ভাষাকে রক্ষা করেও মানুষ হিন্দি বা ইংরেজি শিখছে জীবিকার প্রয়োজনে এবং সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের উদ্দেশ্যে। ফলে তারা স্বেচ্ছায় বহুভাষিক হয়ে উঠছে। এখানে ভাষা শেখা বাধ্যবাধকতা নয়, বরং একধরনের দক্ষতা ও আত্মোন্নয়নের অঙ্গ।

এছাড়াও মিডিয়া এবং সাংস্কৃতিক প্রসারের বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় টেলিভিশন, সিনেমা, ওয়েব সিরিজ কিংবা অনলাইন কনটেন্টের কেন্দ্রবিন্দু অনেকটাই হিন্দি। এই মাধ্যমগুলোকে অনুসরণ করতে গিয়ে অ-হিন্দিভাষীরা হিন্দি ভাষা শিখে নিচ্ছেন, কিন্তু হিন্দিভাষীরা অন্যান্য ভাষার কনটেন্টের দিকে সেভাবে আকৃষ্ট হন না। ফলে ভাষা শেখার পরিসরও একমুখী থেকে যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও বৈষম্য রয়েছে। হিন্দি বেল্টে তুলনামূলকভাবে গরিব ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বেশি। এইসব এলাকায় প্রযুক্তি, ইন্টারনেট বা বহুভাষিক শিক্ষার সুযোগ এখনো শহরাঞ্চলের মতো বিস্তৃত নয়। ফলে ভাষার জগতে তাঁদের গণ্ডি অনেক ছোট। অন্যদিকে শহরকেন্দ্রিক রাজ্যগুলোতে, যেমন কেরল, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক বা দিল্লিতে ইংরেজি এবং অন্য ভাষার চর্চা অনেক বেশি, যা বহুভাষিকতাকে আরও উৎসাহ দেয়।

এই প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আজকের তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক ও এক্স (সাবেক টুইটার)-এর মাধ্যমে একাধিক ভাষার কনটেন্টে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তবে এখানেও দেখা যায়, অ-হিন্দি রাজ্যের তরুণরা হিন্দি ও ইংরেজি—দু’ভাষায় সাবলীল, কিন্তু হিন্দি বেল্টের বড় অংশ এখনও স্থানীয় ভাষা ও ইংরেজির বাইরে যেতে পারছে না। এতে একটি সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া অসমানভাবে গড়ে উঠছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই একভাষিকতা কি সমস্যা তৈরি করছে?

হ্যাঁ, ভাষিক বৈচিত্র্যহীনতা ভবিষ্যতে হিন্দি-বেল্টের শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্বায়নের যুগে ভাষা হল শক্তি—যত বেশি ভাষা জানবে, তত বেশি তথ্য, সংস্কৃতি ও চাকরির সুযোগের দরজা খুলবে। একদিকে দক্ষিণ ভারতীয় ছাত্ররা তিন বা চারটি ভাষায় দক্ষ হয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সামিল হচ্ছে, অন্যদিকে হিন্দি বেল্টের ছাত্রছাত্রীরা অনেক ক্ষেত্রেই হিন্দি এবং সামান্য ইংরেজির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। এর ফলে তাঁদের উচ্চশিক্ষা, বহুজাতিক চাকরি, গবেষণা, সাহিত্য বা আন্তর্জাতিক যোগাযোগে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, ভাষা হচ্ছে সহনশীলতা ও বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান গঠনের হাতিয়ার। যারা একাধিক ভাষা জানেন, তাঁরা অন্য সংস্কৃতিকে বুঝতে এবং শ্রদ্ধা করতে শিখেন। এর ফলে জাতিগত ও ভাষাগত সংঘাত অনেকাংশে কমে আসে। কিন্তু যারা কেবল একটি ভাষায় নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন, তাঁরা অনেক সময় অন্য ভাষাভাষীদের প্রতি ভুল ধারণা, অবজ্ঞা বা প্রতিরোধের মনোভাব পোষণ করতে পারেন, যা জাতীয় ঐক্যর জন্য হুমকি।

তবে এই একভাষিকতার সমস্যার সমাধান কী?

প্রথমত, হিন্দি বেল্টের রাজ্যগুলিতে বহুভাষিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে। প্রাথমিক স্তর থেকেই অন্য ভাষা শেখার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। তা হতে পারে স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ও একটি অ-হিন্দি ভারতীয় ভাষা।

দ্বিতীয়ত, মিডিয়াকে আরও বৈচিত্র্যময় করতে হবে। টেলিভিশন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অন্য ভারতীয় ভাষার কনটেন্ট সহজলভ্য ও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে, যাতে হিন্দিভাষী দর্শকরাও অন্য ভাষার সংস্কৃতিতে আগ্রহী হন।

তৃতীয়ত, সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম বাড়াতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন রাজ্যের ছাত্রদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত মেলবন্ধনের উদ্যোগ নিতে হবে।

চতুর্থত, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে বহুভাষাজ্ঞানের মূল্যায়ন করতে হবে, যাতে নতুন ভাষা শেখার প্রতি উৎসাহ জন্মায়।

শেষ কথা, ভারত এক বহুভাষিক গণতন্ত্র। এখানে ভাষার বৈচিত্র্যই হল ঐক্যের প্রকৃত ভিত্তি। যদি হিন্দি বেল্ট এই বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেয় এবং গ্রহণ করে, তবে তবেই প্রকৃত অর্থে 'এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত' গঠিত হতে পারে। অন্যথায়, এক ভাষার আধিপত্য এক সময়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠতে পারে।

তাই এখন সময়—একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের, যেখানে ভাষা কোনও বিভাজনের অস্ত্র নয়, বরং সংযোগের সেতু হয়ে উঠবে। কারণ, একাধিক ভাষা জানলে আপনি শুধু নতুন শব্দ শিখছেন না, আপনি শিখছেন নতুন ভাবনা, নতুন মানুষ, নতুন সংস্কৃতি—এবং নতুন এক ভারত।

# Image by Dissolve 

 

ads banner


ads banner

Bangla eDaily to resume soon



Tags: