Select language to read news in your own language

কোবরা যেখানে অতিথি নয়, আত্মীয়!

যোগমায়া আচার্য


মহারাষ্ট্রের সোলাপুর জেলার শেতফল গ্রামটি বিশ্ব মানচিত্রে সাধারণ গ্রাম নয়; এটি এক ধরনের ‘মানব–সাপ সহাবস্থান’ ক্ষেত্র, যেখানে মানুষ ও কোবরা একসঙ্গে বাস করে, একে অপরকে পরিবারের সদস্যের মতো মেনে নেয়। প্রতি ঘরেই এক কোবরা বা একাধিক সাপের জন্য বিশেষ ‘দেবস্থান’ তৈরির প্রচলন রয়েছে, যাকে মানুষ ভগবান শিবের প্রতিনিধি বা ‘শিবদেবের দূত’ হিসেবে বিশ্বাস করে । এখানে প্রতিটি ঘরের দেয়ালে ছোট্ট একটি গহ্বর—সাপের আসন—নির্মাণ করা হয়। নতুন বাড়ি, নতুন আশ্রয়ে সাপের জায়গা পাওয়া যেনই কর্তব্যের বিষয়।

গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা সাপকে ভয় পায় না, বরং মিলেমিশে বসে ও ঘুমায়। এমনকি গ্রামের শিশুদের সাপের সঙ্গে খেলা করার দৃশ্যও সাধারণ—ঘরের ছাদে অথবা খোলা আকাশের নিচে স্কুলের মাঠে, কোবরা ছন্দে ছন্দে ঘুরে বেড়ায়। এই অভিজ্ঞতা প্রথম শুনতে অদ্ভুত হলেও, গ্রামবাসীরা জানান, সাপ নিজেও ক্ষিপ্রতা দেখায় না, মানুষ আর সাপ দু’পক্ষই একে অপরকে কয়েক প্রজন্ম ধরে চেনেই আছে

সাপ পালন না করেই এখানে শুধু বিশ্বাসের শক্তির ওপর নির্ভর—সাপকে খাওয়ানো হয় দুধ, মিষ্টি ও জল। Nag Panchami এবং মহরাশ্ট্রীয় পঞ্জিকায় সংশ্লিষ্ট উৎসবের সময় পূজার আয়োজন আরও বৃহৎ হয়। সাপ এবং মানুষের এই আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গ্রামকে একটি অনন্য আভিজাত্য দেয়। এখানে শাপের কামড়ে আক্রান্তের ঘটনা দেখতে পাওয়া যায় না—বর্তমান প্রজন্মের কেউ দাবি করেন না, কোনো মৃত্যুর খবর নেই

এই গ্রাম পৃথিবীর বন্যপ্রাণী সম্পর্কের প্যাটার্ন বদলে দিয়েছে। যে জায়গায় সাধারণ মানুষ ভয় পায়, সেখানে এখানে ভক্তি, বিশ্বাস ও সাদর্থ্যের চমকপ্রদ নমুনা পড়া যায়। প্রতিটি বাসিন্দা বিশ্বাস করে—সাপ এখানে বিধাতা ও জীবনের অংশ। আর তাই, সাপের প্রতি শ্রদ্ধা—এই গ্রামের অন্যতম সুরক্ষা গ্যারান্টি।

তবে এসব কিছুরই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।

# সাপ সাধারণত মানুষকে দূরে রাখতে চায়—কোনো আক্রমণাত্মক মনোভাব নেই।

# যারা সাপের সাথে দীর্ঘদিন বসবাস করে, তারা তাদের আচরণ, শরীরের ভাষা বুঝতে সক্ষম হয়—ফলশ্রুতিতে সাপ ডক্টর বা জানালা হিসেবে কাজ করে

# সোলাপুর অঞ্চলে বন্য ও কাঁচা মাটি-ঘর, খামারের উপস্থিতি—ইনডিয়ান কোবরাদের প্রয়োজনীয় বাস্তুসংস্থান ঠিক আছে, তাই সাপ পৌঁছলে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে চলে যাবার অভ্যাস রয়েছে।

ফলে, এই গ্রামে মানুষের সচেতনতা, নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিশ্বাস ও সহজ শারীরিক পরিবেশের সমন্বয়ে মানুষ–সাপ এই অনন্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সময়ের সঙ্গে সাপও জানতে শিখেছে—এ মানুষ ক্ষতিকারক নয়, বরং তারা সম্মানিত পৃষ্ঠপোষক। এই বন্ধন কেবল ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক নয়, বরং বায়োডাইভার্সিটি ও সাপ সংরক্ষণে অবদান রাখছে।

তবে বিপজ্জনক হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়—অতিরিক্ত আতিথেয়তা, সাপকে প্রতিবেশে ঢুকিয়ে অনুপ্রবেশের সুযোগ তৈরি করা, শিশুদের নিরাপত্তা—এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কোবরা হলে বিষাক্ততা ও কতিভাবে আচরণ করবে—এ বিষয়গুলো জানা জরুরি। ডাক্তার, প্রাণীবিজ্ঞানী এবং স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ না থাকলে বিপদ এড়ানো কঠিন।

শেতফল গ্রামকে শুধু ইথিক্যাল বা কুইরকি ঘটনাস্থল নয়, বরং এটি মানব–প্রাণী সহাবস্থানের এক প্রকৃতিক উদাহরণ, যার থেকে শেখার আছে: ভয় নয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সচেতনতা। পৃথিবীর কোথাও যদি দেখার প্রয়োজন হয়, মানুষ এবং কোবরা কীভাবে নিরাপদে সহাবস্থান করতে পারে—এই গ্রাম সেই লাইভ ল্যাব।

আগামী দিনে, প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে গবেষণাক্ষেত্র, ধর্মীয় পর্যায়েও শেতফলের এই মডেল কাজে লাগানো যায়—জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও মানুষের প্রতি ভয়কে শ্রদ্ধায় রূপান্তর করার প্রণায়। কিন্তু এ জন্য দরকার সতর্ক পরিকল্পনা, স্থানীয় প্রশাসনের সাপোর্ট ও আন্তর্জাতিক সংরক্ষণ সংস্থার নজর। নয়তো, এক পালে দুধ দিতে গিয়ে অপর পালে মৃত্যুশাশুড়ি ঠেকে।

শেতফলের সেই প্রাণান্তর, সেই ভয়ের অদ্ভুত উৎস থেকে সৌভাগ্যের গল্পে রূপান্তর হয়ে গেছে; তাই এটি একটি অনন্য “মানবতা শিখন”, ইতিহাস, বন্যপ্রাণী ও বিশ্বাসের সঙ্গে একাকী যোগাযোগ—যেখানে ভয়ের পরিবর্তে বেড়ে ওঠে যন্ত্রণা, যেখানে কোবরা না থাকে শত্রু, বরং গ্রহণের প্রতীক।

শুনতে অদ্ভুত, কিন্তু যা দেখা যায়—মানুষ আর কোবরা এক সঙ্গে ঘরে, ঘুমে, মাঠে—‘যেখানে ভয় নেই, অভিযোজন আছে’। আর সেটি হয়তো সবচেয়ে বড় শিক্ষা বিশ্ববাসীর জন্য।

ফটো সংগৃহীত

ads banner


ads banner

Bangla eDaily to resume soon