Select language to read news in your own language

একটি কবিতার শতবর্ষ পেরিয়ে

পাঠক মিত্র



       
একটা কবিতা একশো তিন বছর আগে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে ছিল এই বাংলায় । সেই আগুন বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিল । মাথা উঁচু করে বীরের মত বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল । এমন একটি কবিতার জন্য একটি পত্রিকা সংখ্যার পুনর্মুদ্রণ করতে হয়েছিল । শুধু সেই পত্রিকার পুনর্মুদ্রণ হয়নি । সেই পত্রিকা থেকে অন্যান্য পত্রিকায় পরপর তার পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল । 'বিজলী' নামক এই পত্রিকা এক সপ্তাহে পুনর্মুদ্রণ সহ উনত্রিশ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল তখন । তারপর 'মোসলেম ভারত', 'প্রবাসী' পত্রিকায় তার প্রকাশ ঘটে । একটা কবিতার জন্য পত্রিকার এই চাহিদা মনে হয় একশো বছর সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা । অথচ অনেক সাহিত্য অনুরাগী মানুষ সেই কবিতাকে তখন কাব্যের মর্যাদা দিতে চায়নি । বরং তার বিরোধিতা করে সেই কবিতাকে ব্যঙ্গ করে কবিতাও লিখেছিল এক গোষ্ঠী । গোষ্ঠী শুধু রাজনৈতিকভাবে গড়ে ওঠে না যা এখনকার প্রতিটি ক্ষেত্রে চোখে পড়ে, কিন্তু সাহিত্যের আঙিনায় গোষ্ঠী একশো বছর আগেও ছিল । 
যে কবিতা নিয়ে এত কথা সেই কবিতাটি হল 'বিদ্রোহী' । এই কবিতার নামেই কবিকে চিনে নিল সবাই । হাবিলদার কবি হয়ে উঠলেন বিদ্রোহী কবি । কবি নজরুল ইসলাম । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বেঙ্গলি রেজিমেন্ট তুলে দিল ব্রিটিশরা । বাংলার তরুণদের দেশপ্রেমের জোয়ারে এই রেজিমেন্টে বিদ্রোহের বিপদ থেকে বাঁচতে ব্রিটিশরা ভেঙে দিল ঊনপঞ্চাশ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট । রেজিমেন্টে থাকাকালীন তাঁর লেখা নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে তিনি সাহিত্য জগতে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন । যুদ্ধ ফেরত হাবিলদার কবি প্রথমে উঠলেন রমাকান্ত স্ট্রিটে কাশিমবাজার মহারাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বোর্ডিং হাউসে । বাল্য বন্ধু শৈলজানন্দের ব্যবস্থাপনায় । তখন ওই ইন্সটিটিউটে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছেন শৈলজানন্দ । তারপর 32 নং, কলেজস্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে । এপ্রিল, 1920 । এরপর একবছর বাসা বদল হয়েছে কয়েকবার । অবশেষে 1921 সালের জুলাইয়ে উঠলেন 3/4, তালতলা লেনের এক বাড়িতে । সঙ্গী মুজফ্ফর আহমেদ । ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ । যিনি কাকাবাবু নামে কম্যুনিস্ট পার্টি কর্মী ও নেতাদের কাছে পরিচিত । আহমেদ সাহেবের সাথে তালতলার বাড়িতে থাকাকালীন 1921 সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কবি লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'বিদ্রোহী' । তখন অসহযোগ আন্দোলন সফলতার পথে এগিয়ে চলছে । তখন সেই কবিতা বিদ্যুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ল বাংলার সর্বত্র । এ বিদ্রোহ অত্যাচারের বিরুদ্ধে । এ বিদ্রোহ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যা-কিছু মিথ্যা, পুরাতন, কলুষিত তার বিরুদ্ধে । যা-কিছু ভণ্ডামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে । তিনি বললেন, "আমি দুর্বার/আমি ভেঙে করি সব চুরমার ।/ আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল/আমি দলে যাই যত বন্ধন,/যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল ।" সমস্ত শৃঙ্খল ভাঙতে সেই পারবে যে বীরের মত মাথা উঁচু করে চলতে পারবে । এমন চলা জেগে ঘুমিয়ে থাকলে হবে না । তাই তিনি প্রথমেই বলে উঠলেন, "বল বীর-/ বল উন্নত মম শির !/ শির নেহারি আমারি,/নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির !"   
কবিতাটি লেখার পর কবি প্রথম শুনিয়েছিলেন আহমেদ সাহেবকে । তাঁকে মুগ্ধ করতে পারেনি এই কবিতা । তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন । তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, " বিদ্রোহী কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা ।...নজরুল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আমাকেই প্রথম পড়ে শোনাল, অথচ আমার স্বভাবের দোষে না পারলাম তাকে আমি কোনো বাহবা দিতে, না পারলাম এতটুকুও উচ্ছ্বসিত হতে । কি যে কথা আমি উচ্চারণ করেছিলাম তা এখন আমার মনেও পড়ছে না ।" এই কবিতার দ্বিতীয় শ্রোতা 'মোসলেম ভারত' পত্রিকার আফজাজুল হক । আর তৃতীয় শ্রোতা অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, যিনি বোমার মামলায় বিপ্লবী বারীন ঘোষের সহবন্দী ছিলেন । এই দুই শ্রোতাই 'বিদ্রোহী' কবিতায় মুগ্ধ এবং উচ্ছ্বসিত । তাঁরা দুজনেই কবিতার কপি নিয়েছিলেন পত্রিকায় ছাপানোর জন্য । 'মোসলেম ভারত' পত্রিকায় ছাপার আগেই 'বিজলী' পত্রিকায় ছাপার ব্যবস্থা করলেন অবিনাশবাবু । প্রথম প্রকাশিত হল 6 ই জানুয়ারি, 1922 (22শে পৌষ, 1328) । এই কবিতা সমাজের সমস্ত আচ্ছন্নকে যেন দূর করে দিতে লাগল । যৌবনকে আরো গতিময় করে তুলল । বাংলাজুড়ে তরুণ সমাজ টগবগ করে ফুটে উঠল । এ সম্পর্কে তদানীন্তন সময়ের বিশিষ্ট সাহিত্য অনুরাগী ও সাংবাদিক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, " 'বিদ্রোহী' কবিতাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের খ্যাতিতে বাঙালি সমাজ টগবগ করে ফুটে উঠল । তরুণ সমাজ তো 'বিদ্রোহী'র ভাষায় বাক্যালাপ শুরু করে দিল । সকলের মধ্যে সেই মনোভাব--'আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ ।' শুধু তরুণদের নয় কিশোরদের মধ্যেও 'বিদ্রোহী' কবিতা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সেদিন । বিশিষ্ট সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তখন কিশোর । ওই বয়সে 'বিদ্রোহী' কবিতার অনুভূতি তাঁর এক স্মৃতিকথায় বলেছেন, '..'বিদ্রোহী' পড়লাম ছাপার অক্ষরে মাসিকপত্রে--মনে হল, এমন কখনো পড়িনি । অসহযোগের অগ্নিদীক্ষার পরে সমস্ত মন-প্রাণ যা কামনা করছিল, এ যেন তা-ই, দেশব্যাপী উদ্দীপনার এ-ই যেন বাণী ।' 
এই কবিতা যখন গুরুদেবকে নিজের কন্ঠে শুনিয়েছিলেন, তখন কবিগুরু নজরুলকে বলেছিলেন, "তুমি আমাকে নিশ্চয় অতিক্রম করে যাবে । তোমার কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি । আশীর্বাদ করি তোমার কবিপ্রতিভায় বিশ্বজগৎ আলোকিত হোক ।" কবিগুরু তখন সাহিত্য জগতে রবির আলোয় আলোকিত করছেন । শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যে ঢেউ তুলেছেন । বাংলা সাহিত্য জগতে নবাগতরা তাঁর ধারায় প্রবেশ করছে । ঠিক এই সময়ে নজরুল হাঁটা শুরু করলেন তাঁর নিজস্ব ধারায় । কবি অরুণ মিত্রের কথা অনুযায়ী বলতে হয়, 'রবীন্দ্রনাথের আলোকসামান্য প্রতিভার ছটায় যখন দেশবাসী মন্ত্রমুগ্ধ, তখন নজরুল হাঁটছেন তাঁর স্বতন্ত্র পথে রবীন্দ্র-পরিধির বাইরে । মনে হয় সে জন্যেই তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে এত স্নেহ পেয়েছেন ।' 
রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে স্বয়ং স্নেহ করেছেন, কিন্তু তদানীন্তন সময়ে নজরুলের সাহিত্যের বিরোধিতা করেছেন রবীন্দ্র- অনুসারী অনুগামী কবি ও অন্যান্য লেখকগণ । 'বিদ্রোহী' কবিতার বিরুদ্ধে কবি মহিতলাল মজুমদার প্রচার করেছিলেন এই বলে যে নজরুল তাঁর 'আমি' কথিকার ভাবসম্পদ চুরি করে এই কবিতা লিখেছেন । যদিও তা প্রমাণিত হয়নি । এমনকি 'বিদ্রোহী' কবিতার ব্যঙ্গ করে লেখা হয়েছে 'ব্যাঙ' নামক কবিতা ( আমি ব্যাঙ/লম্বা আমার ঠ্যাং....) এবং তা ছাপা হয়েছে 'শনিবারের চিঠি' পত্রিকায় । এই কবিতার সূত্রেই কবি সজনীকান্ত দাস ও মোহিতলাল মজুমদার নজরুলের বিরোধিতায় মেতে উঠেছিলেন । শুধু তাই নয় 'শনিবারের চিঠি' পত্রিকা পুরোপুরি নজরুলের বিরুদ্ধে আক্রমণে মেতে উঠেছিল । কখনো তা শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল । একজন কবি বা লেখকের বিরুদ্ধে 'শনিবারের চিঠি' পত্রিকার মাধ্যমে একের পর এক সংগঠিত নগ্ন আক্রমণ মনে হয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম কালো অধ্যায় ।  
আসলে 'বিদ্রোহী' কবিতা নজরুলকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে তখনই । এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখেছেন, 'নজরুলের কবিতাটি যে একান্ত আত্মগত প্রেরণের ফল তা কাব্যরসিক মাত্র স্বীকার করবেন । নতুবা রবীন্দ্রপ্রতিতা যখন মধ্যাহ্নদীপ্তিতে বিরাজমান তখনই নজরুলের আকস্মিক আবির্ভাব দল গোষ্ঠী নির্বিশেষে এমন সংবর্ধিত হত না ।' আর এই খ্যাতিই হয়তো তাঁর প্রতি একশ্রেণীর বিরুদ্ধাচরণের একটা কারণ হতে পারে । 
অবশ্য পরবর্তীকালে কবি সজনীকান্ত দাশ নজরুলের লেখার গুণগ্রাহী হয়ে উঠেছিলেন । তিনি লিখেছেন, 'রবীন্দ্রযুগেও কবি নজরুল ইসলাম বাঙালি সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারিয়াছিলেন বিদ্রোহের কবি হিসাবে--এই বিদ্রোহ প্রধানত বর্তমান রাজনৈতিক শৃঙ্খল ও বন্ধনের বিরুদ্ধে ।...বাংলাদেশের মত অনড় ও জড় দেশকে জাগাইবার জন্য যে আবেগময় উচ্ছ্বসিত প্রাণবন্যার প্রয়োজন ছিল কবি নজরুলের মধ্যে তাহার প্রকাশ ঘটিয়াছিল ।' নজরুলের কবিতা সম্পর্কে কবি অরুণ মিত্রের স্মৃতির কথা আর একবার বলতে হয় । তিনি বলছেন, ' আমার জীবন যখন আসন্ন রাত্রির সামনে তখন, আমার এই বয়সেও, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পড়তে গেলে আমি যৌবনে প্লাবিত হই । আমার স্মৃতির জাগরণ ঘটে । তরুণ বয়সী শ্রোতা আমি, শুনছি কলকাতার অ্যালবার্ট হল মঞ্চে কবির স্বকন্ঠের আবৃত্তি তাঁরই রচিত বিখ্যাত কবিতা 'বিদ্রোহী' । নজরুলের আয়ত চোখের ঔজ্জ্বল্য, কন্ঠস্বরের প্রবলতা
, দৃপ্ত দেহভঙ্গি আজও আমার দৃষ্টির সামনে ফুটে ওঠে ।..তাঁর কবিতা যখন এই বয়সে পড়ি, তার উচ্ছলতা আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয় ।' 'বিদ্রোহী' কবিতা সেই উচ্ছলতার উৎস । ডঃ সুশীল গুপ্ত বলেছেন,'.. বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিম্বলিক কবিতা 'বিদ্রোহী' । নজরুলের এই সার্থক সিম্বলিকের মূলে কাজ করেছে তাঁর অপ্রতিহত দুর্দান্ত, পৌরুষ, উদ্দাম, উন্মুক্ত হৃদয়াবেগ এবং বীর্যবন্ত চির উন্নতশির অহমিকা ।' তাঁর চির উন্নতশিরের অহমিকা কি আজও সিম্বলিক হয়ে আছে ? তিনি তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতায় সেই উন্নতশিরে বিদ্রোহকে শান্ত করতে চেয়ে বলেছিলেন, 'যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-/ বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত !' আজ উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল একশো বছর পরে শেষ হয়েছে কি ? অত্যাচারী এখন কি আর নেই ও তার খড়্গ কৃপাণ আর হাতে নেই? আসলে একশো বছর আগে নজরুলের দেখা অত্যাচারী এখন আর নেই, সময়ের অভিযোজনে রূপের অনেক বদল ঘটেছে তাদের । তাই বাংলা সাহিত্যে নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা ডঃ গুপ্ত'র কথা অনুযায়ী শুধু সিম্বলিক নয়, বিদ্রোহ যা কিছু নজরুলের তা ও কি আজও শুধুই সিম্বলিক !  

ঋণঃ--
1. কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ -- পঃ বঃ বাংলা একাডেমী 
2. চির উন্নত শির -- সারা বাংলা নজরুল শতবর্ষ কমিটি
3. শতবর্ষের আলোকে নজরুল-- সম্পাদনায় দেবেশ্বর ভট্টাচার্য 
4. বাঁশি আর রণতুর্য-- সম্পাদনায় বাহারউদ্দিন 
ads banner


ads banner

Bangla eDaily to resume soon



Tags: