Select language to read news in your own language

জনসংখ্যার চাপ ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

বিয়ার ব্রাউন

অনুবাদ: পিয়া রায়

 

বিশ্বের প্রতিটি জীবনের পেছনে রয়েছে স্বপ্ন, আশা ও আকাঙ্ক্ষা। প্রতিটি নতুন জন্ম শুধুমাত্র একটি নতুন প্রাণ নয়, বরং তা নতুন সম্ভাবনা, নতুন চাহিদা, নতুন চাপও বয়ে আনে। আর এই চাপের কেন্দ্রে রয়েছে পৃথিবীর সীমিত সম্পদ ও সীমাহীন জনসংখ্যা। প্রতি বছর ১১ জুলাই পালিত হয় World Population Day, একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন যা বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয়—জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ শুধু প্রয়োজন নয়, বরং মানবজাতির টিকে থাকার অন্যতম প্রধান শর্ত।

বিশ্বের জনসংখ্যা আজ প্রায় ৮০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার নতুন মুখ যোগ হচ্ছে এই বিশ্বে। এই প্রবল জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনীতি—সবকিছুই পড়ছে ভয়াবহ চাপের মুখে। মানব সভ্যতার সামনে এক ক্রমবর্ধমান সংকট তৈরি হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের প্রজন্মের জীবনযাত্রা, পরিবেশ ও মৌলিক অধিকারকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, শিশুমৃত্যু হার কমে যাওয়া, কৃষি ও প্রযুক্তির অগ্রগতি। এই উন্নতি মানবিক বিবেচনায় গর্বের হলেও, পৃথিবীর ধারণক্ষমতার নিরিখে তা গভীর চিন্তার বিষয়। অধিক জনসংখ্যা মানে খাদ্যের জন্য অধিক চাহিদা, বাসস্থান ও জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনীয়তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বিশাল চাপ। আর এর সবকিছুই নির্ভর করে পৃথিবীর সীমিত সম্পদের উপর, যা অনবরত নিঃশেষিত হচ্ছে।

খবরের আপডেট পেতে লাইক করুন সাতসকাল ফেসবুক পেজ 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও তার প্রভাব ভিন্নভাবে দেখা যায়। উন্নত দেশগুলোতে জন্মহার কমে গেলেও, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে এখনো জন্মহার অনেক বেশি। ফলে বৈশ্বিক জনসংখ্যা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। অনেক দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, খাদ্যাভাব, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সঙ্কট তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে মহামারীর পরে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।

এখন প্রশ্ন হল, এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা কি শুধুই সমস্যা? উত্তর—না। মানুষ নিজেই পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। প্রতিটি নতুন প্রাণের মধ্যে থাকে নতুন সম্ভাবনা, নতুন উদ্ভাবনের শক্তি। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সচেতনতা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ মানে কেবল জন্মহার কমানো নয়, বরং মানবসম্পদকে গুণগত উন্নয়নের মাধ্যমে জাতির অগ্রগতিতে পরিণত করা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। চীন তাদের 'ওয়ান চাইল্ড পলিসি' দিয়ে কঠোর নিয়ন্ত্রণ চালালেও পরে তা শিথিল করেছে। ভারত, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে পরিবার পরিকল্পনা ও সচেতনতার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। তবে শুধুমাত্র সরকার বা প্রশাসনের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, জনসাধারণের মানসিকতার পরিবর্তনও একান্ত প্রয়োজন।

পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষার প্রসার, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষায় জোর, আর্থিক স্বনির্ভরতা ও নারীর ক্ষমতায়ন—এই উপাদানগুলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে কার্যকর। গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার হার বাড়লে জন্মহার কমে যায়। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান তাদের সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জ্ঞানের প্রসারও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সঙ্গে পরিবেশগত সংকটও তীব্রতর হচ্ছে। অধিক মানুষ মানেই অধিক বনাঞ্চল কাটা, অধিক জ্বালানি ব্যবহারের প্রয়োজন, অধিক বর্জ্য উৎপাদন। এর ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা, বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকটও ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও টেকসই উন্নয়নের জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তি মানুষ, আবার মানুষের অবিমৃশ্যকারিতাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিপদ। এ কারণেই প্রয়োজন সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধান। প্রযুক্তি, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক ন্যায়বিচার—সবকিছু মিলিয়ে একটি টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই, তেমনি দরকার মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া।

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস শুধুমাত্র একটি দিন নয়, বরং এটি একটি উপলক্ষ, যেখানে মানুষ নতুন করে ভাবতে শেখে—আমাদের পৃথিবী কি আর কতটা চাপ নিতে পারে? আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কি আমরা একটি বাসযোগ্য, নিরাপদ পৃথিবী রেখে যেতে পারব? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখতে পাই, পরিবর্তন সম্ভব, যদি আমরা এখনই উদ্যোগ নিই। ছোট ছোট সচেতন সিদ্ধান্ত, সমাজের প্রতিটি স্তরে আলোচনার প্রসার, শিক্ষার বিকাশ—এসবই ধীরে ধীরে বৃহৎ পরিবর্তনের পথ খুলে দিতে পারে।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গে কেবল কঠোরতা বা বাধ্যবাধকতা নয়, বরং প্রয়োজন ইতিবাচক ও সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি। পরিবার পরিকল্পনা কেবল জনসংখ্যা কমানোর জন্য নয়, বরং উন্নত জীবনযাত্রার জন্য, নারীর অধিকারের জন্য, সন্তানের সুস্থ ভবিষ্যতের জন্য।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের কাছে সময় অত্যন্ত মূল্যবান। প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে জন্ম নিচ্ছে নতুন মুখ। তাদের জন্য একটি সুন্দর, নিরাপদ, টেকসই পৃথিবী রেখে যাওয়াই আমাদের দায়িত্ব। World Population Day আমাদের এই দায়িত্বের কথা স্মরণ করায়। আসুন, আমরা সবাই মিলে দায়িত্ব নিই, সচেতন হই, ভবিষ্যত পৃথিবীকে রক্ষা করি।

তবেই আমরা বলতে পারব—জীবনের উৎসব হোক প্রতিটি মানুষের জন্য, পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে।

 

ads banner


ads banner

Bangla eDaily to resume soon