পিয়া রায়
২২শে জুলাই, ১৯৪৭—ভারতের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনেই ভারতীয় গণপরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে "তেরঙা" বা ত্রিবর্ণ পতাকাকে আমাদের জাতীয় পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার ঠিক কয়েক সপ্তাহ আগে এই সিদ্ধান্ত ভারতীয়দের মধ্যে এক ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তার বোধ ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। সেই কারণেই, ২২ জুলাই দিনটিকে অনেকেই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাভরে “তেরঙার জন্মদিন” বলে অভিহিত করে থাকেন।
তেরঙার গঠন ও তাৎপর্য
তেরঙা বা ত্রিবর্ণ পতাকার তিনটি রঙ প্রতীকী তাৎপর্যে পরিপূর্ণ। পতাকার ওপরের অংশে রয়েছে গেরুয়া রঙ—যা সাহস, আত্মত্যাগ এবং নৈতিক শক্তিকে নির্দেশ করে। মাঝখানে সাদা রঙটি সত্য, শান্তি ও শুদ্ধতার প্রতীক। নিচে সবুজ রঙটি কৃষি, সমৃদ্ধি ও ভারতবর্ষের ভূমিসংস্কৃতিকে চিহ্নিত করে।
পতাকার মাঝখানে রয়েছে গাঢ় নীল রঙের অশোক চক্র, যার ২৪টি স্পোক বা দন্ত রয়েছে। এই চক্রটি ধর্মচক্র নামে পরিচিত এবং এটি ভারতের আইন, শাসন, প্রগতিশীলতা ও জীবনের গতি বোঝায়। এটি প্রাচীন ভারতের সম্রাট অশোকের স্মরণে সংযুক্ত করা হয়, যিনি শান্তি, অহিংসা ও ধর্মনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
২২ জুলাই ১৯৪৭: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের প্রাক্কালে, জাতীয় পতাকা নির্বাচন করা ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপরিচয় গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ২২ জুলাই তারিখে, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু গণপরিষদের সামনে পতাকার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সেই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং তেরঙা জাতীয় পতাকার মর্যাদা পায়।
পতাকার পেছনের সংগ্রাম
ভারতের জাতীয় পতাকার ইতিহাস শুধুই একটি প্রতীক নির্ধারণের ইতিহাস নয়; এটি এক দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মবলিদান ও জাতীয়তাবাদের প্রতিচ্ছবি। মহাত্মা গান্ধী, পিংগলি ভেঙ্কাইয়াসহ অনেক মহৎ ব্যক্তিত্ব জাতীয় পতাকার গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে পিংগলি ভেঙ্কাইয়া, যিনি বহু রকম পতাকার খসড়া তৈরি করেছিলেন, তিনি এই প্রতীকের আদি স্থপতি হিসেবে পরিচিত।
আজকের দিনে পতাকার মর্যাদা
বর্তমানে, জাতীয় পতাকা কেবল রাষ্ট্রীয় ভবন বা দিবসেই নয়, বরং সাধারণ নাগরিকের হৃদয়ের গর্বের প্রতীক। “হর ঘর তিরঙ্গা” অভিযান, স্কুল-কলেজে পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পতাকা সম্মান—সবকিছুই তেরঙাকে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছে।
তেরঙার জন্মদিন কেবল একটি তারিখ নয়, এটি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক। ২২ জুলাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, একটি পতাকা কেবল কাপড়ের টুকরো নয়—এটি কোটি কোটি মানুষের আশা, আত্মত্যাগ ও একতা-ভ্রাতৃত্বের জীবন্ত নিদর্শন। তাই আজকের দিনে আসুন, আমরা সবাই তেরঙার সম্মানে মাথা নত করি এবং প্রতিজ্ঞা করি—এই পতাকার গৌরব রক্ষা করব সর্বতোভাবে।
জয় হিন্দ!