Select language to read news in your own language

শৌর্যের এক চিরস্মরণীয় উপাখ্যান

 

পিয়া রায়

 

২৬ জুলাই—ভারতের ইতিহাসে এক গর্বের দিন। এই দিনটি শুধু একটি বিজয়ের স্মারক নয়, এটি জাতির সাহস, আত্মত্যাগ এবং অদম্য চেতনার প্রতীক। ‘কার্গিল বিজয় দিবস’ সেই দিন, যেদিন ভারতের বীর সেনানীরা পাকিস্তানের অনুপ্রবেশকারী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এক অবিশ্বাস্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে জয়লাভ করেন। প্রতি বছর এই দিনটিকে উদযাপন করা হয় সেই সাহসী সেনানীদের স্মরণে, যারা প্রভাতের আলো দেখতে না দেখতেই অনন্তের পথে পাড়ি দিয়েছেন দেশের জন্য।

১৯৯৯ সালের গ্রীষ্মে, জম্মু ও কাশ্মীরের কার্গিল সেক্টরে যখন ভারতীয় বাহিনী আবিষ্কার করল যে, পাকিস্তানের সেনা ও জঙ্গিরা নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে ভারতের ভূখণ্ড দখল করে ফেলেছে, তখনই শুরু হয় এক অসম যুদ্ধের সূচনা। শত্রুদের অবস্থান ছিল উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে, যা যুদ্ধের কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত জটিল করে তোলে। তবুও ভারতীয় সেনাবাহিনী, সীমাহীন প্রতিকূলতা এবং মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তাদের চূড়ান্ত সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে শত্রুদের হটিয়ে আবার নিজেদের ভূমি পুনরুদ্ধার করে।

এই যুদ্ধ ছিল শুধুই গোলাবারুদের নয়, এটি ছিল ইচ্ছাশক্তির, দেশপ্রেমের এবং বিশ্বাসের যুদ্ধ। ৫৬ দিনব্যাপী অপারেশন বিজয়-এর প্রত্যেকটি পদক্ষেপ ভারতীয় সেনার ঐক্য ও অধ্যবসায়ের এক জীবন্ত দলিল। ৫২৭ জন সাহসী জওয়ান শহিদ হয়েছিলেন, বহু সেনা আহত হয়ে ফিরে এসেছেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। তাঁদের এই আত্মত্যাগই আজ আমাদের স্বাধীন আকাশের নিচে নিশ্ছিদ্রভাবে বাঁচার অধিকার দিয়েছে।

কার্গিল যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনার সাহসিকতার বহু নজির ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। ক্যাপ্টেন বিক্রম বত্রা, লেফটেন্যান্ট অনুজ নায়ার, গ্রেনেডিয়ার যোগেন্দ্র সিং যাদব, মেজর রাজেশ আদহকরি—এঁদের নাম ভারতবাসীর হৃদয়ে চিরকাল গেঁথে থাকবে। ‘ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর’ বলে বিক্রম বত্রার সেই জয়ের ঘোষণাটি শুধুই একটি সংলাপ নয়, সেটি হয়ে উঠেছিল এক প্রজন্মের উদ্বুদ্ধ করার প্রতীক।

কার্গিল যুদ্ধে শুধুমাত্র সেনারা লড়াই করেননি, লড়েছে তাদের পরিবার, তাদের মা-বাবা, স্ত্রীরা, ভাইবোনেরা। যুদ্ধক্ষেত্রে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা যেমন সাহসিকতার প্রতিমূর্তি, ঠিক তেমনই পেছনে থাকা পরিবারগুলোও ছিলেন এক নিরব সংগ্রামী। তাঁদের চোখের জল, বুকভরা দুশ্চিন্তা এবং হৃদয়ের কান্না এই বিজয়ের গোপন অংশীদার।

কার্গিল বিজয় দিবস আজ কেবলমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি এক জাতির শ্রদ্ধা নিবেদনের দিন। সারা দেশজুড়ে এই দিনটিকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়, স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে রাজভবন পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বীর সেনানীদের স্মরণ করা হয়। দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে, কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়াল-এ অমর জওয়ান জ্যোতি-র সামনে নীরবতা পালন, পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, এবং বিশেষ স্মরণানুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়।

কার্গিল যুদ্ধ আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাও দেয়। এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা, সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব কেবল মুখের কথা নয়—তারা রক্ষা পায় তখনই, যখন তার জন্য কেউ জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে। এটি প্রমাণ করে, দেশের সুরক্ষা কেবল বাহিনীর দায়িত্ব নয়, প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের উপর নির্ভর করে। আমাদের প্রতিটি কাজ, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে করলে, তবেই আমরা সত্যিকারের কার্গিল বিজয়ের উত্তরসূরি হয়ে উঠতে পারি।

বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে কার্গিল যুদ্ধ সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু পাঠ্যবইয়ে নয়, আমাদের সংস্কৃতিতেও সেই বীরত্বের কাহিনিগুলি উঠে আসা প্রয়োজন। সিনেমা, সাহিত্যে, নাটকে, ওয়ার মেমোরিয়াল ভ্রমণে—প্রতিটি ক্ষেত্রেই কার্গিল বিজয় এবং শহিদদের আত্মত্যাগকে তুলে ধরলে, দেশপ্রেমের বীজ নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে আরও গভীরভাবে রোপিত হবে।

কার্গিল যুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে যে, যত শক্তিশালীই হোক না কেন প্রতিপক্ষ, ভারত কখনও মাথা নত করবে না। শত্রু যত উচ্চভূমিতেই থাকুক না কেন, ভারতীয় সেনারা হৃদয়ের উচ্চতায় সবসময় এগিয়ে। ‘অপারেশন বিজয়’ শুধু কার্গিল পাহাড়ের শৃঙ্গ পুনরুদ্ধারের নাম নয়, এটি হলো বিশ্বাসের জয়, সাহসের জয়, দেশের প্রতি ভালোবাসার জয়।

আজ যখন আমরা ঘরে বসে নির্ভয়ে ঘুমোই, তখন মনে রাখা উচিত, কেউ একজন সীমান্তে নিদ্রাহীন রাত্রি কাটাচ্ছেন শুধুমাত্র আমাদের নিরাপত্তার জন্য। সেই অদৃশ্য রক্ষাকর্তাদের স্মরণ করে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, আমরা কার্গিল বিজয় দিবস পালন করি। এটি শুধু অতীতের স্মরণ নয়, এটি ভবিষ্যতের প্রতি প্রতিশ্রুতিও—যে আমরা তাঁদের রক্তে গড়া ভারতকে সজীব, স্বাধীন এবং সমুন্নত রাখব সর্বদা।

এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে দেশে এমন সেনারা আছেন, সে দেশ কখনও হার মানে না। তাই ২৬ জুলাই কেবল একটি তারিখ নয়, এটি ভারতীয় আত্মপরিচয়ের এক জ্বলন্ত প্রতীক—যা চিরকাল স্মরণীয় থাকবে জাতির ইতিহাসে। জয় হিন্দ। জয় ভারত।

 

ads banner


ads banner

Bangla eDaily to resume soon